শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

modhura
Aporup Bangla

মূল: সাদেক চূবাক

যে বানরের মনিব মারা গিয়েছিল

শিল্প-সাহিত্য

ফারসি থেকে অনুবাদ: শাকির সবুর

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ১৪ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ১৫:০৮, ১৫ অক্টোবর ২০২২

সর্বশেষ

যে বানরের মনিব মারা গিয়েছিল

ছবি : অপরূপ বাংলা

[ফারসি ছোটগল্পের বিবর্তনধারার মধ্যবর্তী স্তর বা পরিণত স্তরের গল্পকারদের অগ্রপথিকসাদেক চূবাক-এর জন্ম১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানের বুশাহর-এ এবং ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেরিকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর গল্পের পাত্র-পাত্রীরা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি; যারা সমাজে অন্য সবকিছুর চেয়ে শারীরিক ও মানসিক অনাচারে লিপ্ত। এরা হচ্ছে ‘এন্টিহিরো’ (অহঃরযবৎড়), যারা নিন্দিত ও সমাজচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও পাঠকের অনুভূতিকে আন্দোলিত করে; যদিও এদের অধিকাংশই নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্য ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়। চূবাকের গল্পের যে বিষয়টি তাঁকে তাঁর পূর্বের ও পরের গল্পকারদের থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে তা হচ্ছে, সমাজের বিচ্যুত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন চাক্ষুষ চিত্রগুলো তিনি সযত্নে তুলে এনেছেন।
চূবাকের দৃষ্টিতে সমাজ হচ্ছে সেই পতিতার মতো, যে প্রসাধন আর সাজগোজ করে আছে এবং তার প্রকাশ্যে যা আছে অভ্যন্তরে তা নেই, আর এ কারণেই রীতিসিদ্ধ প্রচলিত সামাজিক জীবনের সাথে বাস্তব জীবনের যে গভীর বিরোধ তা মানুষের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়, তার কদর্যতা এবং মালিন্য দেখা যায় না। চূবাক তাঁর গল্পে ‘কদর্যতা আর নোংরামি তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষকে অবহিত করা এবং এর পরিণামে এগুলোর বিনাশ ও মূলোৎপাটন’ প্রকৃতিবাদী এই বিশ্বাসে আস্থাবান হয়ে সমাজের সেইসব প্রচল নোংরামি এবং কদর্যতার ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন।
চারটি গল্পগ্রন্থে চূবাকের মোট গল্পের সংখ্যা ৩৩। প্রথম গল্প ‘নাফতি’ (কেরোসিন বিক্রেতা) প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে, ইরানের বাম রাজনৈতিক দল তুদেহ পার্টির প্রগতিশীল সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘মারদোম’-এ। এ বছরই ১১টি গল্পের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘খিমেয়ে শাববাজি’ (পুতুল নাচের তাঁবু)। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আন্তারি কে লূতিয়াশ মোরদে বুদ’ (যে বানরের মনিব মারা গিয়েছিল) প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘রোজে আভ্ভালে ক্বাবর’ (কবরের প্রথম দিন) প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। ‘যে বানরের মনিব মারা গিয়েছিল’ তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আন্তারি কে লূতিয়াশ মোরদে বুদ’-এর নামগল্পের অনুবাদ।]

এটা ঠিক যে, বলা হয়ে থাকে ভোর বেলার ঘুম কঠিন নেশাকর হয়। বিশেষ করে লুতি জাহানের ঘুম, যখন সে তার বানর মাখমালকে নিয়ে সাত সকালে ‘পুলে আবগিন’ থেকে পথচলা শুরু করে দিনভর পায়ে হেঁটে ‘কাতাল দুখতার’ টিলা পার হয়ে রাতের শুরুতে ‘বারম উপত্যকায়’ এসে পৌঁছেছিল এবং যতটুকু সম্ভব চা-তামাক ও আফিমের নেশায় মাতাল হয়ে আর বানরকেও কিছু ধোঁয়া-তামাক দিয়ে মধ্যরাত হয়ে গেলে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় এই শুকনো ওকগাছটার গুড়ির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু যতই ক্লান্ত হোক না কেন দিনের এতটা সময় পর্যন্ত তো তার জায়গা থেকে একটুও নড়াচড়া না করা এবং রাস্তা দিয়ে যাতায়াতরত ওইসব ট্রাকের হৈ-হুল্লোড় আর যে কয়লা শ্রমিকরা উপত্যকায় নেমে একের পর এক ওকগাছ জ্বালিয়ে কয়লা করছিল তাদের এত শোরগোল সত্ত্বেও ঘুম না ভাঙা উচিত নয় । 
যদিও মাখমাল তার মনিবের ঘুম ভেঙ্গেছে কি-না তা দেখার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে মাথা উঁচু করে দু পায়ের ওপর বসেছিল, তবে সে হতাশ হয়েছিল এবং তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। আর এখন সে গুটিশুটি মেরে বসে অপেক্ষা করছিল। তার মনিব ঘুম থেকে উঠবে, সেও সমস্তদিন তার মনিবের সাথে পায়ে পায়ে হেঁটে এসেছিল। কখনও দু পায়ে আবার কখনও চার হাতপায়ে হেঁটেছিল এবং ইতিউতি তাকিয়ে দেখেছিল। এখন অবশ্য যতই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, তার মনিব একটুও জায়গা থেকে নড়ছিল না। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। তার হাত-পার তালু ব্যাথা করছিল এবং একেবারে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। এখনো গতকালের ধুলা-মাটি তার লোম আর শরীরের চামড়ায় লেপ্টে ছিল। তার কুকুরের মতো সরু চোয়ালের চোখগুলো যে ওকগাছটার নিচে তার মনিব ঘুমিয়ে ছিল সেদিকে নিবদ্ধ করে বসেছিল। হাতগুলোকে পায়ের নিচে রেখে ঘুমন্ত মনিবের দিকে হতবাক দেখছিল। আবারও তার সংবিৎ ফিরে এলে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক বার নিজের চারপাশে চক্কর দিয়ে পেড়েকওয়ালা যে শিকলটা মাটিতে পোতা ছিল সেটি ধরে টান দিল তারপর আবারও প্রথমবারের মতো পথের দিকে দৃষ্টি ফেলল। কোনো কিছু না ভেবেই চোখগুলো বন্ধ করছিল আর মনিবকে দেখছিল। 
তখনো উপত্যকায় রোদ পড়েনি, উঁচু পাহাড়গুলোর আড়ালে পড়েছিল। কিন্তু ‘কুহে মারে’র পাহাড়গুলোর ফাটল দিয়ে ছায়াময় রোদের নিঃসরণ উপত্যকায় এসে পড়েছিল। তখনো দূরের পাহাড়গুলো ঘুমিয়ে ছিল। সূর্যের আলো তাদের ঘুম ভাঙ্গায়নি। 
উপত্যকাটা ছিল লাল। উজ্জ্বল লাল রঙ আর মাটির ওপর ঠাণ্ডা কুয়াশার আস্তরণ পড়ে ছিল। মাটিমিশ্রিত শিকড়ওয়ালা বড় বড় ওকগাছ উপত্যকায় বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কৃমির মতো দীর্ঘ সরু রাস্তাটা উপত্যকাকে দুই ভাগ করেছিল। উপত্যকার সবদিক থেকে কয়লা হওয়া ওকগাছগুলোর ধোঁয়ার খিলান ভোরের শান্ত-নিঃশব্দ বাতাসে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল আর উঁচুতে উঠতে উঠতে নিশ্চিহ্ন হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
লুতি জাহান এমন একটা শুকনো পুরোনো ওকগাছের গুড়ির ভেতর ঘুমিয়ে ছিল যার একটা সবুজ পাতাও ছিল না। তার অস্থিসার নি®প্রাণ আকাবাঁকা ডালগুলো যবুথবু হয়ে ছিল। বহু মুসাফির দল তার নিচে যাত্রাবিরতিস্থল বানিয়েছিল এবং তার ডালপালা কেটে গুড়ির ভেতর আগুন করেছিল। যার ফলে গুড়ির ভেতর এমন একটা সমাধির মতো ছিদ্রহীন ফাটল তৈরি হয়েছিল যার দেয়ালটা ছিল এক প্রস্থ কয়লার আস্তরে ঢাকা। এই গাছটা যে মারা গেছে তারও বহু বছর পার হয়ে গিয়েছিল। 
লুতি জাহান এই ফাটলের ভেতর নিজের লম্বা কোর্তার নিচে ঘুমিয়েছিল। বালিশটা ছিল গুড়ির ভেতরের দেয়ালের দিকে আর তাতে হেলান দেয়া ছিল সে। তার সামনে মাটির ওপর; তার জ্যাকেটটা পড়ে ছিল, হুকা ছিল; আফিমের পাইপ ছিল; বড় ঝুড়ি ছিল, তামাকের থলেটা ছিল, আফিমের কৌটা ছিল, আর গলে মাটি হয়ে যাওয়া কয়েক টুকরা কয়লাও তার সামনে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার গুটি বসন্তের দাগওয়ালা চেহারা আর পাতলা দাড়ির একটা অংশ লম্বা কোর্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ছোট্ট একটা শরীর লম্বা কোর্তায় মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। 
মাখমাল দুপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার মনিবের দিকে ফিরে দেখল। তার চেহারাটা কুঞ্চিত আর ভ্রƒগুলোও বাঁকা হয়ে পেঁচিয়ে ছিল। লম্বা নাকের প্রান্ত তিক্ষè চোয়ালের সাথে লেগেছিল আর কাঁপছিল। তার জগতটা ছিল ছোট্ট। কোনো বিচার-বুদ্ধি ছিল না তার। মনিবের চাঁদের মতো মুখটা আর কোটরাগত চোখগুলো তার জন্য ছিল নতুন। নিজের এদিক ওদিক ভাল করে লক্ষ করে তারপর আবারও মাটির ওপরে বসল সে। তার চোখগুলো মাটির ওপর ছোটাছুটি করছিল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো কিছু খুঁজছে। 
তাকে তার মনিব একটা বড় গাছের গুড়ির তলায় বেঁধে রেখেছিল। লম্বা মোটা একটা পেড়েক ঘাসে ঢাকা স্যাঁতসেঁতে মাটির ভেতর পোঁতা ছিল আর সেটা ছিল একটা বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু, যা তাকে মাটির সাথে সংযুক্ত করেছিল। সে এবং তার মনিব যে ওকগাছটার নিচে ঘুমিয়েছিল তার মাঝখান দিয়ে একটা সরু পরিষ্কার পানির নালা প্রবাহিত ছিল। 
মনিবের দিকে হতবাক দেখছিল সে। মনে হচ্ছিল তার ভেতর নতুন একটা কিছু দেখেছিল। একবার মনে হলো তার মনিব ঘুম থেকে উঠেছে। কিন্তু তার মুখের ত্বকে কোনো সঞ্চালনই ছিল না। তার চোখগুলোরও সেই সার্বক্ষণিক দ্যুতি ছিল না। তার চেহারাটা ছিল ফ্যাকাশে। অপক্ক চামড়ার মতো ছিল। মনিবের চোখগুলো ছিল খোলা আর বিস্ময়বিহ্বল ভয়ার্ত চোখের মনি সামনের দিকে তাকাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল না মারা গেছে না-কি সদ্য ঘুম থেকে উঠে ভাবছে। মুখটা ছিল পরিষ্কার খোলা আর মৃতের মতো শুকনো। চোখের কোটরগুলো ছিল বিষ্ফারিত ও ঢিলে হয়ে যাওয়া। মুখের কোণা থেকে ডিমের সাদা অংশের মতো আঠালো রস গড়িয়ে পড়ছিল।
মাখমাল ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার নিজের যেটুকু শক্তি ছিল তার সবটুকু দিয়ে নিজের রুক্ষ শরীরটাকে একের পর এক ভূমি থেকে ওপরে তুলছিল আর শূন্যে লাফিয়ে উঠছিল। কিন্তু গলার বেল্টটা তাকে যন্ত্রণা করছিল। তার সমস্ত দৃষ্টি ছিল মনিবের প্রতি। একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিল সে। তার চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আর তাকে ভয় পাচ্ছিল না। সে তার জন্য অপরিচিত হয়ে গিয়েছিল। যতই তাকে দেখছিল তার কিছুই বুঝতে পারছিল না। সেই দিন পর্যন্ত তার মনিবকে এই চেহারায় আর কখনো দেখেনি সে। সেই দিন পর্যন্ত মানুষকে এরকম নিরুপায় ও নিরুপদ্রব দেখেনি সে। সে আর এই চেহারাটাকে ভয় পাচ্ছিল না। যে চেহারাটার প্রতিটা প্রান্তের ত্বকের সঞ্চালন তার জীবনটাকে কাঁপিয়ে তুলত, এখন সেটি তাকে কিছুই বলছিল না। যে চোখগুলোর প্রতিটা ঘুর্ণন তাকে অন্য ভুবনের সব রহস্য বুঝিয়ে দিতো, এখন তা ছিল বিষ্ফারিত, নিশ্চুপ আর নি®প্রভ।
হঠাৎই যন্ত্রণাপূর্ণ একাকিত্বের আতঙ্ক তার ভেতরে কামড় দিয়ে ওঠে। একাকিত্বটা অনুভব করে সে। মনিব তার জন্য সেই ওকগাছের গুড়ির অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানতে পারে যে সে ওই বিশাল উপত্যকায় একা এবং কাউকেই সে চেনে না। অনবরত এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে আর নিজের চারপাশে চক্কর দিতে থাকে। তারপর থেমে উপত্যকার দূর-দূরান্তে যে লোকগুলো আকাশের দিকে উঠে যাওয়া ধোঁয়াগুলোর পাশে কিছু একটা খোঁজাখুঁজি করছিল তাদের লক্ষ করে। তখন আরও বেশি ভয় পায়। সবসময় মনিবের কাছ থেকে যে মার খেতো এবং তার চোখের বিষ দেখতো সেগুলো তার চোখের সামনেই ছিল। তারপর আবারও মাটির ওপর বসে এবং মনিবের চাঁদবদনি মুখের কাছে যায় সে। তারপর তার দুশ্চিন্তাপূর্ণ ক্ষুদ্র চোখগুলোকে যে গাছটার নিচে সে বাঁধা ছিল সেই গাছের ধুলাবালি মাখা ঘোলাটে পাতাগুলোর দিকে নিবদ্ধ করে। তারপর চোখগুলোকে যে ওকগাছটার গুড়ির ভেতর তার মনিব গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে ছিল সেদিকে ফেরায়। যেন তার করণীয় সম্পর্কে তার কাছে জিজ্ঞেস করছিল। 
ঘটনাক্রমে মনিব গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল আর মাখমালও খুব দ্রুত অনুভব করতে পেরেছিল যে মনিব তার কাছ থেকে কয়েক ফারসাঙ্গ দূরে পালিয়ে গেছে এবং তাকে আর চিনতে পারবে না। 
গতকাল তারা এখানে পৌঁছে এই ওকগাছের তলায়ই বিরতি নিয়েছিল। লুতি জাহান এখানে পৌঁছেই মাখমালের শিকলটা মাটির ওপর, ওই ওকগাছের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজে ভয়ে ভয়ে আগুন জ্বালল। তারপর চায়ের কেটলি, গ্লাস, হুঁকা, তামাক, চরসের কৌটা, আফিমের পাইপ এবং আফিম নিজের বড় ঝুড়িটা থেকে বের করে আগুনের পাশে রাখল। তারপর চারটা রান্না করা চড়ই, যেগুলো সে আগের দিন কাজরুন থেকে কিনে রুটির ভাঁজের ভেতর পেঁচিয়ে রেখেছিল, ঝুড়ির ভেতর থেকে বের করে মাখমালের সাথে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর রাতের খাবার খেতে না খেতেই আফিমের পাইপ সাজিয়ে একের পর এক কয়েক স্লিম আফিম শেষ করে এবং শেষ স্লিমে সবসময়ের মতো মাখমালকে ধোঁয়া দেয়। 
মাখমাল তার মুখোমুখি বসে ছিল এবং ধোঁয়ার প্রতিটা বিন্দু গিলছিল। তার নাকের প্রান্তগুলো ছিল পিপড়ার মাথার শিঙের মতো সংবেদনশীল ও উৎসুক। কিন্তু মনিব প্রথম স্লিম নিজেই টানছিল আর ধোঁয়াটা নিজের ফুসফুসের ভেতর চালান করে দিচ্ছিল। মাখমালের প্রতি কোনো মনোযোগই ছিল না তার। যদিও সে জানতো যে সেও তার মতো ধোঁয়া চায় কিন্তু তার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছিল না। মনিবের যখন গাঢ় নেশা হতো আর থলেতে টান পড়তো তখন সে আর মানুষ থাকতো না। শহরেও এরকমই ছিল। মাখমাল চা-দোকানগুলোতে, আফিমের দোকানগুলোতে তার মনিব যে ধোঁয়া উদ্গিরণ করতো তারচে অন্যদের ধোঁয়াই বেশি ব্যবহার করতো।
শহরে যখন সে খেলা দেখাত এবং এক এক করে বাতিগুলো একত্র করত আর লোকদের ঠকিয়ে পালাতে চাইত, তখন মাখমালের মাতলামিকে বাহানা করে ফ্যাসফেসে গলায় বলত: 
‘মাখমাল, মাখমাল জান আমার, ভারতীয় মাতলামি শয়তান! আসক্তির কষ! মাতলামি? আফসোস করিস না এই এক্ষণি তোরে নিয়া গিয়া ধোঁয়া দিমু, ঠিক হইয়া যাইবি।’
কিন্তু চায়ের দোকানে পৌঁছে তার দিকে কোনো গুরুত্বই দিতো না সে। নিজে বসে বসে তৃপ্তি ভরে গাঁজা টানত। তারপর কয়েক পেগ নিঃশ্বাসহীন ঘন ধোঁয়া, যার লালা ও নির্যাস তার ফুসফুস চুষে নিত, মাখমালের দিকে ছুড়ে দিতো। এখনো যে এই মরুপ্রান্তরে ছিল এরকমই ছিল। গত রাতেও মাখমাল যথেষ্ট পরিমাণে ধোঁয়া পায়নি তাই এখনো তার ঢুলুঢুলু অবস্থা ছিল।
গতরাতে ঘুমানোর আগে লুতি জাহান গাঁজায় তৃপ্ত হবার পর কয়েক কলকে হাশিশ সেঁজে একের পর এক বাঁকা হয়ে টানল। মাখমালকেও ধোঁয়া দিয়েছে। তারপর ধীরপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাখমালের শিকলটা ধরে তাকে নালার ওপাশে নিয়ে গেল, একটা গাছের গুড়ির নিচে পেড়েকটা মাটির ভেতর সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে রেখে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ল। 
কিন্তু সেই ঘুমই তার শেষ ঘুম হয়েছে। আর ভোরবেলা মাখমাল যখন চোখ মেলল, সকালের ঝাঁঝালো বাতাসে বুঝতে পারল যে তার মনিবেরও সেই গাছের গুড়ির মতো অবস্থা হয়েছে, শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে এবং তার চোখগুলো নি®প্রভ। তাকে কোনো নির্দেশও দিচ্ছে না এবং তার সাথে তার কোনো কাজও নেই, সে একাকী এবং স্বাধীন। 
ওখানে তার আর কোনো মনিবই নেই। কী করবে বুঝতে পারছিল না। কখনোই নিজেকে মনিবহীন পায়নি সে। মনিব তার জন্য ছিল এমন এক সত্তা, যাকে ছাড়া তার অস্তিত্বই ছিল অসম্পূর্ণ। মনে হচ্ছিল যেন তার মগজের অর্ধেকটা অবশ হয়ে আসছিল এবং কোনো কাজই করছিল না। তার যতটুকু মনে আছে মানুষের মধ্যে একমাত্র লুতি জাহানকেই সে চিনতো; সে-ই ছিল তার স্বভাষী এবং অন্য লোকদের ভুবনে সে-ই সম্পর্ক করে দিতো। সে তার কথার মতো আর কারো কথাই এত ভালভাবে বুঝতো না। এক জীবন তার জন্য বন্ধু আর শত্রুর স্থান দেখিয়ে দিয়েছিল আর পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করেছিল; কিন্তু যা কিছুই সে করেছিল লুতি জাহানের নির্দেশ ও ইশারাতেই করেছিল।
চা-দোকানে, মাঠে-ময়দানে, শোকগাথার আসরে, গাড়ির গ্যারেজে, গোরস্তানে, সরাইখানায়, ছোট বাজারের নিচে, যেখানেই মনিব খেলা দেখানোর জন্য বিছানা পাততো সেখানেই নানা রকমের লোকজন তার এবং মাখমালের চারপাশে জমা হতো। আর সবসময় লোকদের এই স্মৃতি তার মনে ছিল যে তারা শুধু তাকে কষ্ট দেয়া আর আগ্রাসন চালানোর জন্যই তার চারপাশে জমা হতো। এরাই পাথর ও পচা ফল, কাঠ, হাড়, ছেড়া জুতো, ডালিমের খোশা, পশুর বিষ্ঠা, ভাঙ্গা লোহা এসব তার দিকে ছুঁড়ে মারতো এবং সবাই চাইতো সে তার পশ্চাদদেশ শূন্যে তুলে ধরে শত্রুর স্থানটা তাদের দেখিয়ে দিক। 
কিন্তু মাখমাল পাথর খেতো তবুও কারো কথা শুনতো না। তার কান থাকতো শুধু মনিবের ঘণ্টার দিকে, সে তার শিকল ঝাঁকুনি দিয়ে যা কিছু করতে বলতো তাই-ই সে করতো। কখনো এমন হতো যে, সে যেন তাদের অনুকরণ করে এই উদ্দেশ্যে লোকেরা নিজেদের নিতম্ব বাঁকা করে তাকে শত্রুর স্থান দেখাতো। কিন্তু সে তাদের দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে দাঁত ভেংচি কাটতো; তারপর তাদের দিকে পেছন ফিরে ঝালড়ওয়ালা লেজের নিচে লেগে থাকা ফুলে ওঠা বড় ফোঁড়ার মতো উজ্জ্বল লাল পশ্চাদদেশটা তাদেরকে দেখিয়ে দিতো। এই খেলাটা মনিবই তাকে শিখিয়েছিল, যেন বাজে চরিত্রের লোকদেরকে দেখায়। যারা মনিবকে চাটুকারি করতো আর মনিব চাইতো যে লোকজন তার আশপাশ থেকে সরে যাক, মনিব মাখমালের শিকলটা ধরে নাড়া দিয়ে আঠালো স্বরে বলতো: মাখমাল বাজে লোকদের খেলার জায়গা কোথায়?
মাখমাল মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে পশ্চাদদেশটা শূন্যে তুলে ধরতো আর হাতগুলোকে অসহায় ভঙ্গিতে তার ওপর রাখতো আর মুখ দিয়ে তীব্র শোকের শব্দ বের করতো।
‘উম, উম, উম।’
আবারও লুতি জাহান বলতো: ‘যন্ত্রণাকারি লোকদের জায়গা কোথায়?’
আবারও সেরকম পশ্চাদদেশটা শূন্যে তুলে ধরে হাত দিয়ে তার ওপর চেপে ধরতো আর গলা দিয়ে সেরকম অস্পষ্ট শব্দ করতো। 
‘উম, উম, উম।’
এ সবই সে ভয়ে ভয়ে এবং চোরা চোখে মনিবের জন্যই করতো। ‘দুশমন’ এমন একটা গালি ছিল যা তার কানের ভেতর একটা আকৃতি পেয়ে গিয়েছিল, যখনই লুতির মুখ থেকে বেরিয়ে এসে তার কানের ভেতর পৌঁছতো এবং সেই আকৃতিতে জায়গা নিতো তখনই সে তার মাথাটা মাটির ওপর রেখে হাতটাকে পশ্চাদদেশের ওপর রাখতো। এটাই ছিল তার কাজ। এজন্যই তার জন্ম হয়েছিল। 
কিন্তু মানুষ যাই দেখুক না কেন তাতে সে ছিল বেজার। তাদেরকে দেখার চোখ তার ছিল না। তার মনিবের দৃষ্টিই তার পশ্চাদদেশ নাচাতো। সবচেয়ে তাকেই অধিক ভয় করতো সে। তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল সে। তাকে ভয় পেতো। তার জীবনটা তার চারপাশ সম্পর্কে ভয় পাওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যা কিছু তার চারপাশে ছিল তার সবকিছুকেই সে ভয় পেতো। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সে বুঝতে পেরেছিল যে সবাই তার প্রাণঘাতী শত্রু। সব সময় অপেক্ষা করতো কখন মনিবের লাঠি তার মাথার ওপর পড়বে অথবা তার গলার বেল্টে টান পড়বে; অথবা তার পার্শ্বদেশে লাথি পড়বে। যা কিছু করতো বাধ্য হয়েই করতো। যা কিছু দেখাতো বাধ্য হয়েই দেখাতো এবং যা কিছু খেতো বাধ্য হয়েই খেতো। 
এমন একটা শিকল ছিল যার মাথাটা ছিল অন্য কারো হাতে এবং শিকলওয়ালা যেখানে খুশি তাকে টেনে নিয়ে যেতো। তার হাতে কিছুই ছিল না। সমস্ত জীবন তাকে শুধু টেনে নিয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু এখন হঠাৎই সে দেখতে পেল, এই পর্যন্ত তার মনিবের দেহ থেকে যত শক্তি বের হতো এবং তাকে বশীভূত করতো, তার সবটুকুই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমন কোনো বাঁধনই আর ছিল না যা তাকে তার মনিবের সাথে আটকাতে পারে। তার মনিব এমন এক অন্ধকার নি®প্রভ লাশ হয়ে গিয়েছিল, যার প্রতি মাখমালের আর কোনো রকমের নির্ভরতাই ছিল না। মাটির মতো হয়ে গিয়েছিল। এখন তার প্রতি মাখমালের যে ঘৃণা ছিল তা প্রসমিত হয়ে গিয়েছিল এবং এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যা তার চারপাশের মাটি ও শক্ত রুক্ষ পরিবেশে ছিল।
খানিক বসে মাথা চুলকালো। তারপর হতবুদ্ধি কয়েকবার নিজের চারপাশে চক্কর দিল। হঠাৎই শিকলের ওপর চোখ পড়ে। সেটি দেখে। এই পর্যন্ত এভাবে বিস্ময়পূর্ণ ও প্রতিহিংসার চোখে সেদিকে আর দেখেনি সে। সেটি ছিল রুক্ষ, জঙধরা আর ভারি। সবসময় এরকমই ছিল; যখন থেকে সে নিজেকে চিনেছিল তখন থেকেই সাপের থাবার মতো তার চারপাশে পেঁচিয়ে ছিল সেটি। তাকে টেনে নিয়েও গিয়েছিল এবং আটকেও রেখেছিল আর তার পালানোর পথও বন্ধ ছিল। তার এক প্রান্তে লম্বা একটা পেরেক মাটিতে পোতা ছিল আর অন্য মাথা তার গলার চারপাশে বল্টু লাগানো ছিল। সবসময় এরকমই ছিল। যখন থেকে সে নিজেকে দেখেছিল এই বোঝাটা তার ঘাড়েই ছিল। তার শরীরের একটা অঙ্গের মতোই। ওটাকে ভালো করেই চিনতো এবং মনিব ও অন্যান্য সবকিছুর মতো ওটার প্রতিও অসন্তুষ্ট ছিল সে। কিন্তু এটাও জানতো যে তার শরীরের অঙ্গের সাথে এর তফাৎ আছে। সেগুলোর চেয়েও ভারি ছিল। ভারি বোঝা টানা এবং ক্লান্তি, কষ্ট, যন্ত্রণা ছাড়া তার মধ্যে আর কিছুই দেখেনি সে। 
শিকলটা দুহাতে ধরে মাটির ওপর থেকে উঁচু করে। হাতটাকে ওপরে তুলে আনে। গলার নিচে নিয়ে যায়; যেখানে আংটা আর বেল্টটা প্যাঁচ লাগানো ছিল। সেটাকে নাড়াতে থাকে এবং অদক্ষভাবে সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। 
হতবুদ্ধিতা ও নির্বুদ্ধিতার সাথে হাতগুলোকে শিকলের নিচ দিয়ে পেরেকের দিকে নিয়ে আসে। এক হাতে সেটাকে ধরে অন্য হাতে সেটা ছেড়ে দিতে থাকে। হাতগুলোর সাথে নিজেও পেরেকটা যে মাটিতে গাড়া ছিল সেদিকে চলে যেতে থাকে, যেন একটা বাঁধনে ঝুলে গিয়েছিল এবং হাত দিয়ে তার ওপর দিয়ে হাঁটছিল। শিকলের মাথায় গিয়ে পৌঁছে যেটি আর তার নিজের আয়ত্তে ছিল না, ছিল অন্য এক ভুবন, যা তাকে আটকে ফেলেছিল। 
লুতি জাহান মাখমালের শিকলের পেরেকটাকে তার শক্ত গোলকাঠ পর্যন্ত মাটিতে পুতে রাখতো। বলতো: ‘তোর চাইতে দুষ্ট বানর দুনিয়াতে আর নাই। মানুষের চোখে যতটুক পারস বিষ ঢাইল্যা দ্যাস। একসময় দেখবি মানুষই তোরে ঘুমের মধ্যে মাইরা রাখছে।’
মাটির মধ্যে শিকলের পেরেক ঢুকানো তার কাছে ছিল খুবই স্বাভাবিক। সবসময়ই সে দেখতো যখন তার মনিব সেটাকে মাটিতে ঢুকাতো তখন সে ওখানেই বন্দি হয়ে থাকতো, সেখানেই মাটির সাথে আটকে থাকতো। কোনো জোরাজুরি করতো না। অভ্যাস ও ভয় তাকে সেখানেই আটকে রাখতো। কখনো কখনো অনুভব করতো তার পেরেকটা একেবারে হালকা এবং মাটির ভেতর নড়বড় করছে। কিন্তু নিজেকে মুক্ত করার কোনোই চেষ্টা করতো না সে। তবে এখন ছিল অন্যরকম। এখন যেভাবেই হোক সেটাকে তুলে ফেলতে চাচ্ছিল সে। 
পেরেকের আঙটাটাকে দুহাতে চেপে ধরে ক্রোধের সাথে সেটাকে নাড়া দিল। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার আর কোনো বিপদ নেই, আর কোনো মারামারির দরকার নেই। পেরেকটা উপড়ানোর জন্য সে যে শক্তি খাটাচ্ছিল তা ছিল প্রয়োজনের চেয়েও অধিক। সেও জানতো যে কীভাবে হাতগুলোকে ব্যবহার করতে হবে? তাই তার শক্তিশালী বৃদ্ধাঙ্গুলের মাধ্যমে  পেরেকের চারপাশে চেপে ধরল সে। তারপর যতটুকু শক্তি ছিল তার সবটুকু দিয়ে পেরেকটাকে নাড়া দিল এবং অবশেষে সেটিকে মাটি থেকে বের করে ফেলল। 
নিজেকে মুক্ত করায় আনন্দ হলো তার। হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু শিকলটাও তার পেছন পেছন চলছিল আর তার সাথে সাথে লাফালাফি করছিল। সেটিও তার সাথে আনন্দ করছিল। সেটিও তার সাথে মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু দুজনই দুজনের সাথে বাঁধা ছিল। এবং এইবারও শিকলটা বিরক্তিকর শব্দে ও একাকিত্বের নৈঃশব্দ্যে তার পেছন পেছন চলছিল। মাখমাল হতাশ হলো। মনঃক্ষুণ্ন হলো। কিন্তু কোনো উপায়ও ছিল না তার। 
মনিবের লাশের দিকে হেঁটে গেল। ছোট্ট একটা লাফে নালাটা পার হয়ে খানিক সোজা দাঁড়িয়ে সন্দেহের সাথে মনিবের দিকে তাকিয়ে তারপর সামনে গেল। কিন্তু তার কাছাকাছি পৌঁছতেই দ্বিধায় পড়ে গেল সে। সুতরাং ওখানেই তার থেকে একটু দূরে, তার মুখোমুখি খানিক বসল। তখনো ভয় পাচ্ছিল তার বিনা ইশারায় কাছাকাছি যেতে।
লাশটা আধশোয়া গাছে হেলান দেয়া ছিল। তার চারপাশে ঝালড়ওয়ালা লম্বা কোর্তাটা পেঁচানো ছিল। সামনে গতরাতের আগুনের ছাই, নেভানো চুলা, কেতলি, হুঁকা, আফিমের পাইপ, বড় ঝুড়িটা আর ঘটি ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিল। 
এরকম ছিল যেন লাশটা তার পরিত্যাক্ত সম্পদের দিকে দেখছিল। 
মাখমাল এখন ভাল করেই জানতো যে সে এক টুকরো পাথরের মতো পড়ে ছিল এবং নড়াচড়া করছিল না। তার ওপর থেকে সে তার দৃষ্টি ফেরাল। তারপর উপত্যকায় যে ধোঁয়ার খিলানগুলো ওপরের দিকে যাচ্ছিল সেগুলোর দিকে ফিরে তাকাল। দূর-দূরান্তের লোকগুলোর দিকে তাকাল। তাদেরকে ভয় পাচ্ছিল। তারা সবাই ছিল তার জন্য অপরিচিত। 
 জায়গা থেকে উঠে তার মনিবের কাছে গিয়ে তার খুব কাছাকাছি বসল। মনিবের মুখ তাকে কিছুই বলছিল না: বলছিল না চলে যা, বলছিল না বস, বলছিল না হুঁকা সাঁজ, বলছিল না লুঙ্গি মাথায় পেঁচা, বলছিল না মোমবাতি হ, বলছিল না বন্ধু এবং শত্রুর জায়গা কোথায়, বলছিল না তোর চোখগুলো বন্ধ কর। বলছিল না, ‘বেশ তুই একটা তলোয়ার, শিক্ষা নে একটা তলোয়ার।’ বলছিল না ‘সওয়ারি আসছে, চতুর সওয়ারি আসছে।’ বলছিল না ‘এই হালুয়া হালুয়া হালুয়া, গরম মিষ্টি হালুয়া।’ তাকে কিছুই বলছিল না। যতই তার মুখের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল তার সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। এ কারণেই তার অন্তরে তার প্রতি কোনো রকম ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছিল না। সেই প্রাত্যহিক মারপিট ও নির্যাতন, যা ছিল তার মনিবের নির্দেশেরই অংশ, তা তার চেহারা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলেছিল এই কাঠামো আর চেহারার তার সাথে আর কোনো কাজই থাকতে পারে না। 
মাখমাল তার মনিবের প্রতি ছিল ত্যাক্ত বিরক্ত। কারণ এমন কোনো কাজই ছিল না যা সে মাখমালের কাছ থেকে ভয় না দেখিয়ে চাইতো। জাহান যে সময় তার সহকর্মী ও খেলা দেখানোর সময় বাজে লোকদের মাধ্যমে মনঃক্ষুণ্ন হতো তখন মাখমালের ওপর তার ঝাল মেটাতো। বেত, থাপ্পর, লাথি এবং শিকল দিয়ে তাকে মারতো আর মুখে যত অশ্লীল গালি আসতো সবই দিতো। মাখমালও তার মনিবের গালিগুলো চিনতো এবং তাদের ভীতিকর ধ্বনিগুলো তার কানে পরিচিত ছিল। তার মনিবের অশ্লীল গালিগুলো শুনে তার ভেতর এমন অবস্থা তৈরি হতো যে অবশ্যই ভয় পেতে হতো এবং কাক্সিক্ষত কাজটি তাকে দ্রুত সমাধা করতে হতো এবং মনিবের পায়ের তলায় মাথাটাকে বাঁকা করে দিয়ে অনুনয় ও কাকতির সাথে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো যাতে আর মার খেতে না হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কখনো কখনো আগুন হয়ে যেতো, বিরক্ত হয়ে খারাপ খেলা দেখাতো এবং মনিবের হাত থেকে শিকলটা এমন টান মারতো যে নিরুপায় হয়ে সেটি শিথিল করতো এবং কিছুক্ষণ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তাকে পোষ মানাতে নানা কিছু দিতো, জোর করে বাদাম ও কিসমিস খাইয়ে দিতো। সেও অবশেষে পোষ মানতো, কিন্তু কখনো কখনো মারের মাথায়, যখন মনিব খেলা দেখানোতে মেতে উঠতো এবং মাখমালের কাছে অধিক কাজ আশা করতো, সেও কথা শুনতো না এবং মনিব যতই তার মাথায় পেটাতো ততই অবাধ্য হয়ে যেতো সে, তার আনুগত্য করতো না এবং তার নির্দেশ মানতো না। 
তখন জাহানও তাকে কোনো গাছে বাঁধতো অথবা তাকে এতটাই মারতো যে কলজের ভেতর থেকে আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসতো তার, গলার মধ্যে শব্দ গড়গড় করতো। কিন্তু কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসতো না। কেউই তার ভাষা বুঝতে পারতো না। সবাই হাসতো আর তার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতো। কখনো কখনো যন্ত্রণার আতিশয্যে সে নিজেকেই কামড়ে ধরতো এবং মাটি ও ধুলায় গড়াগড়ি করতো আর চিৎকার করতো এবং মুখটা বস্তার মুখের মতো এমন হা করতো যে ভেতর পর্যন্ত দেখা যেতো আর নিজের জিহ্বাটা কামড়াতে থাকতো। লোকেরা আনন্দ করতো আর হাসতো। কারণ ‘হাজি ফিরোজ মার খেতো।’
তবে মাখমালের জন্য সবচে খারাপ শাস্তি ছিল ক্ষুধা আর ধোঁয়া না পাওয়া। জাহান যখন ভয়ানক বিদ্বেষ দেখাতো তখন তাকে ক্ষুধার্ত ও ধোঁয়াহীন রাখতো এবং বেশি খাবার দিতো না। তাকে বেঁধে রাখতো যাতে নিজে খাবার জন্য কিছুই খুঁজে না পায়। যদি মুক্ত থাকতো তাহলে আবর্জনার স্তুপে গিয়ে লতাপাতা ও বিষ্ঠার ঢাকা মাটিতে নিজের জন্য কিছু একটা খুঁজে বের করতো। অথবা যদি ধোঁয়া চাইতো তাহলে মানুষের মতো চা-দোকানের সামনে বসে থাকতো এবং অন্যদের ধোঁয়ার গন্ধ উপভোগ করতো। কিন্তু সে মুক্ত ছিল না।
আস্তে করে অধিক কৌতূহলে হাত বাড়িয়ে মনিবের মাথার ওপর থেকে লম্বা কোর্তাটা নিচে টানলো সে। 
চুলার সাথে বাঁধা আলকাতরার মতো যে উজ্জ্বল রাতের টুপিটা মাথার নিচে দেয়া ছিল সেটি দৃশ্যমান হয়ে উঠল। ময়লার আস্তরণে ভরা মনিবের মুখটা যেন চুনাপাথরের মূর্তির ওপর পানির ছিটা পড়েছে এমন শিথিল ছিল।
মাখমালের ভেতর আকস্মিক আনন্দের সৃষ্টি হয়, যেন একটা নারী বানর দেখতে পেয়েছে সে। যেন তার মনিব অনেক দূর থেকে, যেখানে তাদের মাঝখানে ছিল একটা বড় নদী, তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং তাকে নাগাল পাচ্ছিল না। তার শিরা-উপশিরায় এক ধরনের কামনাপূর্ণ আনন্দ ছুটোছুটি করে। সে অনুভব করে মনিবের ওপর বিজয়ী হয়েছে সে। তার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল এবং তাকে ভাল করে লক্ষ করছিল। তার গলা থেকে কয়েকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ বেরিয়ে এলো: ‘গি, গি, গি।’
তারপর হাত বাড়িয়ে ঝুড়ির ভেতর থেকে রুটির পোটলাটা বের করে দুটা রান্না করা চড়ুই তার ভেতর থেকে বের করল এবং দ্রুত তা গিলে ফেলল। তারপর রুটিগুলো যা ছিল তাও খেল। কোনো উদ্বেগ ছিল না তার। সে ছিল উৎফুল্ল-আনন্দিত। 
মনিবের হুঁকাটা মাটি থেকে তুলে তার মাথা ও কাঠের দিকে তাকালো এবং অদক্ষতার সাথে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। সেটাকে মুখে পুরল। মনিব যখন জীবিত ছিল তখন তার নির্দেশে তার জন্য হুঁকাতে তামাকের থলে ভরে তাতে তামাক দিতো সে। এখন বেপরোয়াভাবে তামাকের থলেটা মাটি থেকে তুলল। সেটাকে উল্টে ফেলেছিল। মাটির ওপর তামাক ছড়িয়ে পড়ল। সেও আঙ্গুল দিয়ে সেগুলোকে মাটির ওপর লম্বা দাগ টেনে দিল। এবং সক্রোশে মনিবের দিকে লক্ষ করল। তারপর হুঁকাটা দূরে ছুড়ে মারল। আবারও অসভ্যভাবে মনিবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। 
ধোঁয়ার প্রতি জ্বালাময় আসক্তি সৃষ্টি হয়েছিল তার। তাই নেভা উনুনের পাশ থেকে আফিমের পাইপটা তুলে স্বীয় নাকের নিচে ধরল। তার নাকের প্রান্তগুলো মুণ্ডিত হয়ে ছিল। কোষ্ট রোগের মতো চকরা-পাকড়া হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার আফিমের পাইপটাকে বিরক্তি ও অসন্তোষের সাথে আঙ্গুলে মাটিমাখা কালো তেলে ঘুরাল। তারপর সেটি সুঁকে চুষনিটাকে মুখে পুড়ে চিবিয়ে ভেঙ্গে ফেলল। পাইপের ভেতরের পোড়া তেতো তার বিরক্তি উদ্রেক করল। কিন্তু গন্ধের নির্যাস তার নাকের ভেতর পেঁচিয়ে তার আসক্তিকে আরও উস্কে দিল। চিবিয়ে ভেঙ্গে ফেলা পাইপের গুড়াগুলো থুথু আকারে ফেলে দিল। সেগুলোতে মুখে আঘাত পেয়েছিল। তারপর সেগুলোকে উনুনের কাছের পাথরের ওপর পিটিয়ে গুড়া গুড়া করল। তারপর উত্তেজনাবশে বেশ কয়েকবার জাহানের লম্বা কোর্তাটা টানাটানি করল। তার কাছে সাহায্য চাচ্ছিল। চাচ্ছিল সে জেগে উঠুক। অবশেষে নিরাশ হয়ে আস্তে করে জায়গা থেকে উঠে মনিবের দিকে পেছন ফিরে উপত্যকার দিকে হাঁটতে লাগল সে। 
উপত্যকাটা আরো আলোকিত হয়ে  উঠেছিল। তার ভেতর রোদ ছড়িয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হচ্ছিল এমন গলিত তামার রঙ ছিল। তার ভেতর ট্রাকের ভোঁ ভোঁ শব্দ পাঁক খাচ্ছিল।
কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। সবসময় মনিব তার পাশে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে হাঁটতো; একটা দেয়ালের মতো। কিন্তু এখন মাটির ওপর কঙ্করে পিছলে যাওয়া শিকলের শব্দটাই শুধু তার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছিল। শিকলটা ছিল তার যমজ। এখন শুধু সে-ই ছিল আর ছিল তার শিকলটা। এবং তার শিকলটা সবসময়ের চেয়ে অধিকতর ভারী হয়ে তার হাত-পায়ে আটকে ধরছিল আর যন্ত্রণাকর শব্দ তার একাকিত্বকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। 
কয়েকটা পাথরের চাঁই পার হলো সে। এখন মনিবের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছিল। দুই পায়ে ভর করে হাঁটছিল। তার ছোট্ট লেজটার মাথায় ঝালর ছিল। তার স্থূল দেহটা শিকলটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আর বাঁকা হয়ে পথ চলছিল। কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। যেখানে খুশি যেতে পারছিল। শিকল টেনে ধরার কেউ ছিল না। নিজেই নিজের শিকলটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছিল। এমন এক অন্যভুবনের দিকে যাচ্ছিল সেটি কোথায় তা সে জানে না; কিন্তু এরকম অনুভব করছিল যে সেখানে কোনো মনিব থাকবে না। সে হবে স্বাধীন। 
চারণভূমির দিকে এলো, যেখানে ভেড়ার পাল চরে বেড়াচ্ছিল। সেগুলোর সবার মাথা ছিল নিচের দিকে আর ছোট ছোট ঘাস কামড়াচ্ছিল তাড়া। নিজেদের মধ্যে চক্কর খাচ্ছিল আর তাদের মাথা নিজেদের কাজে বন্ধ ছিল। একটা রাখাল ছেলে ঘাসের ভেতর পা মেলে শুয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিল। চারণভূমিতে খণ্ড খণ্ড মাটিমাখা ওকগাছের ভারী ভারী গুড়ি বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। মাখমাল চারণভূমির প্রান্তে একটা ওকগাছের নিচে বসে রাখাল ও ভেড়াগুলোর দিকে তাকাল।
খানিক বিশ্রাম নিয়েছিল সে। এই সামান্য দূরত্ব, যেটুকু সে নিজের ইচ্ছেমতো এসেছিল, তাকে জীবন্ত করে তুলেছিল। ভেড়ার পাল দেখে তার ভালোলাগল। অনুভব করছিল যে রাখাল ছেলেটা ওখানে বসে ছিল তার কাছে সে ছিল ভেড়াগুলোর চেয়ে অধিক পরিচিত এবং নিকটতর। তার জন্য নতুন এক ব্যস্ততা তৈরি হয়েছিল। কারো কাছে কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু অনবরত নিজের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিল। তার শরীরে ভয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। 
এই সময়ে ময়ূরনীল পাখাওয়ালা বড় একটা মাছি উত্তেজিত হয়ে অনবরত তার চোখেমুখে এসে আঘাত করতে লাগল এবং তাকে যন্ত্রণা করতে শুরু করল। তার চোখের কোণে এসে বসছিল আর তাকে কামড়াচ্ছিল। মাখমাল দক্ষতার সাথে প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত সেটিকে আঙ্গুলের মধ্যে আটকে ফেলল। সেটাকে কিছুক্ষণ দেখে তারপর তাকে মুখে পুড়ে খেয়ে ফেলল। 
ভেড়ার পালটা মুক্ত চরে বেড়াচ্ছিল। রাখাল ছেলেটা মাখমালকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ছুটে এলো। তার লাঠিটা ঘাড়ের পেছনে রাখা ছিল আর নিচ থেকে দুহাত ওপরে এনে সেটিকে ধরে রেখেছিল। মনিবের খেলার মধ্যে সবসময় মাখমাল এই কাজটা করতো। মনিব তার লাঠিটা মাখমালকে দিয়ে গাইতে থাকতো ‘বেশ বেশ রাখাল, রাখালি শিখ।’ মাখমালও লাঠিটাকে ঘাড়ের পেছনে রেখে দুহাত দুইপাশ থেকে তার নিচ দিয়ে ওপরে এনে ধরে হাঁটতো আর নাচতো। ঠিক এই রাখাল ছেলেটার মতো। 
রাখালটাকে তার ভালোলাগল। তার মতোই ছিল যাকে সে অনুকরণ করতো। জায়গা থেকে একটুও নড়ল না। নিজের জন্যই বসেছিল আর হাতগুলোকে দুপায়ের মাঝখানে রেখে তার দিকে আসতে থাকা রাখালের দিকে দেখছিল। রাখাল ছেলেটা কাছাকাছি এসে সতর্কতার সাথে তার সামনে এক লাঠি দূরত্বে এসে দাঁড়াল। সকৌতূহলে এবং অধীর আগ্রহে এই জন্তুটার প্রতি, এর আগে এরকম একটা জন্তু একবার শুধু এক গ্রামে দূর থেকে সে দেখেছিল, দেখতে লাগল। তার কান, হাত, পা, চোখ এবং চেহারার দিকে, যেগুলো ছিল তারই মতো, দেখতে লাগল। তার মন চাচ্ছিল তার কাছাকাছি গিয়ে তাকে ধরে কোলে নিয়ে তার সাথে খেলা করতে। তার এবং নিজের মধ্যে একটা সম্পর্ক সে দেখতে পেল, যা সে ভেড়াগুলোর মধ্যে দেখেনি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটুকরো রুটি, যেটি শুকিয়ে দেয়াল থেকে তোলা চুনা পথরের মতো হয়ে গিয়েছিল, বের করে এনে মাখমালের শরীরের নিম্নাংশের মধ্যে ছুঁড়ে মারল এবং মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রইল। 
মাখমাল দ্বিধার সাথে সেটি তুলে শুঁকল। তারপর অনাগ্রহের সাথে সেটি দূরে ছুঁড়ে মারল। সংশয় ও সতর্কতার সাথে রাখাল ছেলেটার দিকে লক্ষ করছিল এবং তাকে মোটেই ভয় পাচ্ছিল না। তার কাছ থেকে কোনো বিপদই অনুভব করছিল না সে। তার প্রতি তার অন্তরে কোনো ঈর্ষাই ছিল না। কিন্তু সতর্কভাবে দেখছিল যে সে তার ওই লম্বা লাঠিটা দিয়ে কী করতে চাচ্ছে। সে লাঠিকে এবং তা দিয়ে কী কাজ করা যায় তা নিজের জীবনে খুব  ভাল করেই জানতো। লাঠি ছিল তার শত্রু। 
অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে চমকানো সূর্যের আলোর মতো তার ক্ষুদ্র চোখগুলো তীক্ষè ও তীব্রভাবে তার ভ্রƒর নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর ঘাড়ের লোমগুলো খাড়া করে আপাদমস্তক রাখালের প্রতি লক্ষ করছিল সে। অধিক সতর্কতা ও সংশয়ের সাথে রাখাল ছেলেটাকে দেখছিল। কারণ সে তার পাহাড়ি বাদাম গাছের গিট গিট লাঠিটাকে হাতের মধ্যে নাড়াচ্ছিল আর মাখমালও সবসময় এরকম জন্তুর কাছ থেকে যন্ত্রণা ও নির্যাতন পেয়ে আসছিল। সে তার মতো যেসব জন্তু ছিল এবং যেসব জন্তুর তার সাথে সাদৃশ্য ছিল সেগুলোকে ভালো করেই চিনতো। অন্যান্য জন্তুর চেয়ে এ ধরণের জন্তুগুলোকে অধিক দেখেছিল সে। 
রাখাল ছেলেটা আরও সামনে পা ফেলল। মাখমাল তবুও জায়গা থেকে নড়ল না, শুধু তার চোখগুলো তার চলার সাথে সাথে ঘুরতে লাগল। ছেলেটা তার একাকিত্ব ও নিজের ভেতর যে লজ্জা পেয়েছিল সে কারণেই জানতে চাচ্চিল যে সে কী এবং কী করতে চাচ্ছে। হঠাৎই হাতের লাঠিটা বাড়িয়ে তার দিকে খোঁচা মারল। কিন্তু সহসাই নিজেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। লাঠিটা মাখমালের লাগল না। 
এখন মাখমাল অধিক সতর্কতার সাথে রাখালের দিকে দেখছিল। তার শরীরটা ছিল ক্লান্ত অবসন্ন। হাত-পায়ের তালু জ্বালা করছিল। ধোঁয়ার অভাবে শরীরটাতে শীত শীত লাগছিল। আতশদানের সামনে বসে যে তামাক সাঁজতো এবং তাকে ধোঁয়া দিতো মনিবের সেই দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ছিল। এটিই ছিল তার একমাত্র অতীত স্মৃতি। যতই সে তার পাতলা ঠোটগুলো এবং সরু নাকটা নাড়াচ্ছিল এবং নিঃশ্বাস নিচ্ছিল কিন্তু তামাকের কোনো গন্ধই পাচ্ছিল না। উঠে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু অনুভব করতে পারছিল যে রাখালের প্রতি পেছন ফেরা উচিত হবে না।
 ছেলেটা মাখমালের নিস্পৃহতা ও নিরুপদ্রবে সিংহ হয়ে ওঠল। আবারও লাঠিটাকে বাড়িয়ে ধরে হঠাৎই মাখমালের মাথায় আঘাত করল। মাখমালও এক লহমায় নিজেকে বারুদের চরকির মতো তৈরি করে রাখাল ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কাঁধের ওপর হাত রেখে চোখের পলকে ছেলেটার গালে শক্ত করে কামড়ে ধরল এবং এক টুকরো গোশত তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। ছেলেটা ভীত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আর তার মুখ থেকে স্বচ্চ রক্তের ধারা বের হলো। সেই দিন পর্যন্ত মাখমাল আদম সন্তানকে এরকম যন্ত্রণা দেওয়ার মতো আর কোনো সুযোগ পেয়েছিল না। 
যেভাবে ছেলেটা নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়ে আর্তচিৎকার করছিল ওই অবস্থায়ই মাখমাল কয়েক লাফে সেখান থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের অজান্তেই যে পথে এসেছিল সেই পথ ধরল। এই একটা মাত্র পথই সে চিনতো। এই কঙ্করভূমি, যেটি দিয়ে সে এসেছিল, পার হলো। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। 
বিশাল প্রশস্ত একটা উপত্যকা তার চারপাশ ঘিরে রেখেছিল, যার মধ্যে সে হারিয়ে গিয়েছিল। কোনো পথ ও উপায় জানা ছিল না তার। না কোনো খাবার ছিল, না কোনো ধোঁয়া ছিল, না এমন কোনো পরিপূর্ণ হাতিয়ার ছিল, যা দ্বারা সে নিজের এই পরিবেশে বীরত্ব দেখাতে পারে। তার শরীরের গোশত রূঢ় ও যন্ত্রণাকর পরিবেশের তুলনায় ছিল নিরুপায় ও অপ্রতিরুদ্ধ এবং ছিল পচনশীল। কানগুলোকে তীক্ষè করে সবুজের ভেতর বিচরণ করা ক্ষুদ্র গোবরে পোকার শব্দেও ভয় পাচ্ছিল সে এবং কেঁপে উঠছিল। তার চারপাশে যা কিছু ছিল সবই তার সামনে অত্যাচারী ও জীবনবিনাসী শত্রু বলে দৃশ্যমান হচ্ছিল।
শরীরের ক্লান্তি ও অসাড়তা তাকে নিরুপায় করে তুলেছিল। একটা বাঁকানো পাথরে এসে আশ্রয় নিল এবং যতদূর পারে নিজেকে দুটি পাথরের মাঝখানে সৃষ্টি হওয়া একটা গর্তে রাখল। দুর্দশাগ্রস্ত ও বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছিল, খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তার সহজাত প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলেছিল এবং আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল। নিজের সামনের দিকে তাকাচ্ছিল আর ছায়ামূর্তিগুলোকে ও কাঠ কাটায় রত কুঠারওয়ালাদের পর্যবেক্ষণ করছিল। তার কাছে লোকগুলোর অবস্থা ছিল কাকতাড়ুয়ার মতো। তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল সে। তাদেরকে ভয় পাচ্ছিল। তার মনের ভেতর তাদের প্রতি একটা চিরন্তন ও অন্তহীন ভয় ছিল, এখনো যতটুকু সম্ভব নিজেকে তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছিল। 
মাটির ওপর থেকে কয়েকটা ঘাসের ডগা ছিড়ে গন্ধ শুঁকল। সেগুলোর তীব্র টাটকা স্বাদ তাকে জীবন্ত করে তুলল। তার মুখের স্বাদ বদলে গেল। আবারও কিছু ঘাস খেল, তার গলাটা সিক্ত ও জীবন্ত হয়ে ওঠল। উরদি বেহেশত  মাসের ঘুমপাড়ানি কড়া রোদ তার পেট ও বুকের লোমে এসে লাগছিল আর শরীরের ত্বকে মিষ্টি ঘুমপাড়ানি সুরসুরি দিচ্ছিল। পাথরের দিকে পেছন ফিরে ছিল এবং গমের শিষগুলোর প্রতি, যে গুলো ছিল মাটির ওপর চির বসন্তের বিছানা, দেখছিল। নিচের ঠোঁটটাকে সামনে এনে সেটাকে খানিক নাড়াল, গলার ভেতর একটা পিচ্ছিল শব্দ হলো তাতে। যেন হাসছিল। 
তারপর যে গর্তটার ভেতর গুটিসুটি মেরে বসেছিল তার ভেতর নিজেকে আরও ভালভাবে রাখল। পেছনের পাথরে পশ্চাদদেশটা চেপে ধরছিল আর ক্লান্তি তাড়াচ্ছিল। একবার আনন্দিত হয়ে নিজের স্বাধীনতাটা অনুভব করল সে। সন্তুষ্ট ছিল। যেন কঠিন একটা যন্ত্রণাকর নির্বাসিত বোঝা তার ঘাড় থেকে অপসারিত হয়েছে। 
বগলের নিচে মাথাটা নিয়ে জায়গাটা চুলকাল। মাথাটা আনন্দিত অবস্থায় ঘাড়ের ওপর কাত করা ছিল। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাকে শরীর মর্দন করে দিচ্ছিল। তারপর পেটটা চুলকাল। তারপর সোজা হয়ে বসে নিজের পেট, উরু ও পায়ের মাঝখান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করল। শরীরের লিক ও উকুনগুলোকে এক এক করে তীক্ষè নখের সাঁড়াশিতে আটকে দাঁতের নিচে রেখে রেখে খেতে লাগল। পেটের চামড়াটা ছিল রূপালি আর তার ভেতর নীল সিড়াগুলো ছুটোছুটি করছিল।
সমস্ত শরীর একটা কামনার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছিল। যেন তৎক্ষণাত তার সামনে একটা নারী বানর কামোত্তেজিত হয়ে তার পায়ের মধ্যখানটা মেলে ধরেছিল। যন্ত্রণাকর চোখগুলো বুঁজছিল আর মাতালভাবে নিজের সামনটা দেখছিল। হাতটা উরুর চিপায় নিয়ে পায়ের মধ্যখানটা চেপে ধরল। যখন তার মনিব নিজের সাথে খেলা করতে চাইতো তখন তার মনিব লাঠি দিয়ে আঙ্গুলের ওপর শক্তভাবে আঘাত করতো। কিন্তু  যেহেতু শক্তিশালী ছিল তাই মনিবই সব সময় বিজয়ী হতো এবং প্রার্থীও পাওয়া যেতো। তাকে প্রজননের জন্য নারী বানরওয়ালা মনিবদের কাছে ভাড়া দেওয়া হতো। 
মাখমালের জীবনে দু একবার সংঘটিত হওয়া দাম্পত্যই ছিল একমাত্র যৌনস্মৃতি, যা তার নারী প্রজাতির স্মৃতি তার জন্য অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু মনিব জাহান ভাড়া না পেলে কখনোই তাকে নারী বানরের সাথে মিলিত হতে দিতো না। এই জন্যই মাখমাল নারী বানরদের দূর থেকে দেখতো, যাদের গলায় শিকল লাগানো থাকতো আর তাদের মনিবরা তাদের টেনে নিয়ে যেতো এবং তাদের পরস্পর কাছাকাছি আসতে দিতো না। যেই তারা কাছাকাছি আসতে চাইতো অমনি দুদিক থেকেই তাদের শিকলে টান পড়তো এবং মাথার ওপর লাঠি ঘুরতে থাকতো। 
কখনো কখনো এমন হতো যে মনিব খেলার খরিদদারদের ঠাট্টা-মসকরা ও হাসানোর জন্য অনর্থক একটা কুকুরের বাচ্চা অথবা বিড়ালের বাচ্চা মাখমালের সামনে ছুঁড়ে দিতো। মাখমালও সেগুলোকে হাতের মধ্যে নিয়ে তাদের চেপে ধরতো ও শুঁকতো এবং স্বীয় পায়ের মাঝখানে নিয়ে নিজেকে অদক্ষভাবে ঝাঁকাতো। তারপর সেগুলোকে দূরে ছুঁড়ে মারতো। এ ধরণের কাজে কোনো রকমের তৃপ্তি বা সন্তুষ্টিই সে পেতো না। 
এখন তো সে একাই ছিল এবং মনিবের কোনো ভয়ই ছিল না। তার শরীরের ক্লান্তি ও অবসন্নতা চলে গিয়েছিল। উষ্ণ হয়ে উঠেছিল সে। আনন্দপূর্ণ নতুন এক শক্তি তার শিরা ও ত্বকে ছুটোছুটি করছিল। অনবরত তার ভেতর যা লেপ্টে ছিল তার ওপর হাতটাকে উপর-নিচ করছিল। তার ত্বক তার ওপর গড়িয়ে নামছিল। বুঝতে পারছিল না কী করবে। কিন্তু চোখ ছিল ভেতরগত এক ভিন্ন পথে। পরিচিত এক তৃপ্তিকর আনন্দের প্রত্যাশা করছিল। একটা শারীরীক আনন্দ তাকে সহায়তা করছিল। তার শরীর কাঁপছিল। নিজেকে যন্ত্রণাকরভাবে মালিশ করছিল। বিষাদময় অবস্থায় তড়িঘড়ি হতচকিত হয়ে নিজের সামনের দিকে দেখছিল। সবকিছু বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে ভুলে গিয়েছিল। মেরুদণ্ডের মধ্যে একটা চুলকানি দেওয়া কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। ধীরে ধীরে সংবিৎ হারিয়ে ফেলছিল। চোখগুলো আধবোঁজা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই একটা শক্তিশালী দৈত্য ঈগল আকাশের গহিন থেকে দ্রুত তার দিকে ঝুঁকে এলো। রক্তখেকো হিংসুক ঈগল তার উন্মুক্ত থাবা ও নখ দিয়ে মাখমালের দিকে হামলা করল।
নিজেকে রক্ষা করার উত্তরাধিকারী ক্ষমতায় অন্যদের সব আগ্রহের ওপর মাখমালের জীবন বিজয়ী হলো। ভীত সন্ত্রস্ত জায়গা থেকে উঠে দুপায়ের ওপর দাঁড়াল সে। বিপদ অনুভব করতে পেরেছিল। মনে হচ্ছিল যেন পাগল হয়ে গেছে। প্রতিরক্ষার জন্য তার দাঁতের কামড় আর থাবা মুক্ত হলো। হাতগুলোকে মাথার ওপর তুলে শক্তিশালী দাঁতগুলো বের করল। কিন্তু শিকলটা তার কাজ ব্যহত করছিল। ঘাড়টাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল এবং মাটির দিকে টেনে ধরছিল। সম্ভবত যে সময়টুকু সে নিজেকে স্বাধীন মনে করছিল তার সবটুকুতেই হয় শিকলটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল অথবা যেহেতু সেটি ছিল তার শরীরের একটি অঙ্গের মতোই এবং সবসময়ই সেটি দেখছিল তাই সেদিকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছিল না। 
ঈগলটা দ্রুত তার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল আর ভয় ও শংকার একটা পাহাড় তার মাথার ওপর এসে পড়ল। যে ক্ষীপ্রতার সাথে সে নিচে নেমে এসেছিল সেই ক্ষীপ্রতায়ই উঁচুতে উঠে গেল সে। দুজনই দুজনকে ভয় পেয়েছিল। খানিক নিজের চারপাশটা দেখে নিল। এর প্রতিও হতাশ হয়েছিল সে। এখানেও আর বসবাসের জায়গা ছিল না। তার শান্তি বিঘ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আবারও ভয় পাচ্ছিল। নিজের চারপাশে সামান্যতম সহায়তা ও সহমর্মিতার চিহ্নও দেখতে পাচ্ছিল না। সবকিছুই ছিল অপরিচিত এবং ভয় প্রদর্শনকারী। যেন মাটির ওপরের সবখানে সুই গেঁথে রাখা হয়েছিল। ওখানে আর দেরি করা যাচ্ছিল না। মাটি গলিত তাওয়ার মতো তার পাগুলোকে পোড়াচ্ছিল আর তাকে পালাতে বাধ্য করছিল।
ক্লান্ত অসহায় ও ভীত ব্যথিত হাঁটতে লাগল। আবারও যে পথে এসেছিল সেই পথে। সেই পথে, যে পথে বিজয়ীর মতো পালিয়ে এসেছিল এবং স্বাধীনতা অনুসন্ধান করছিল, ফিরে গেল। একটা শক্তি, তাকে সেই লাশটার কাছে, একমাত্র যে সত্তাকে সে দিনের আলোয় নিজের চোখে দেখেছিল এবং তাকে চিনেছিল, টেনে নিয়ে আসছিল। সন্তুষ্টির সাথে এবং ভালোবাসাপূর্ণ ইচ্ছায় সেই পুরোনো শত্রুর দিকে গেল সে, মৃত্যুর পরও যে তাকে নিজের পেছন পেছন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। শিকলটাকে নিজের পেছন পেছন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এটিই সেই শিকল যেটি তাকে টেনে নিয়ে যেতো। 
মনিবের লাশটা অক্ষত অবস্থায় সেখানেই ছিল। এখনো গাছটার সাথে হেলান দেয়া ছিল। মাখমাল তাকে দেখেই আনন্দিত হয়ে ওঠল। তার বন্ধুত্ব শুরু হলো। তার অন্তর নিশ্চিত হলো। তার একাকিত্ব দূর হয়ে গেল। লাশটা একটা অভিনব খেলনার মতো তাকে প্রতারণা করতে লাগল আর নিজের দিকে টানতে লাগল। পালানো থেকেও পরাজিত হয়েছিল। পালানোর কোনো অস্তিত্বই আর ছিল না। পালানোর ফাঁসে জড়িয়ে পড়াকেও ভয় পাচ্ছিল সে। 
মনিবের মৃত্যু তাকে স্বাধীনতা দেয়নি। পালায়ও নি সে। শুধু শিকলের চাপ ও ভারটাই অধিকতর হয়েছিল। সে এমন একটা বৃত্তের মধ্যে চক্কর খাচ্ছিল কোথা থেকে এই পরিবেশের শুরু হয়েছিল এবং কতবার শুরুর জায়গাটা অতিক্রম করেছিল শুধু তা-ই বুঝতে পারছিল না। সবসময় নিজের জায়গায় এবং একটা বিন্দুতে ঘোরপাক খাচ্ছিল সে। 
এখন সম্পূর্ণরূপে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিল সে। সবখান থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছিল। যেখানেই গিয়েছিল বিতাড়িত হয়েছিল। শরীরটায় শীত শীত করছিল। হাত-পাগুলো অবশ হয়ে এসেছিল। গতকালের পথচলা আর ধোঁয়ার অভাবের দুশ্চিন্তা ও আজকের অপরিচিত জীবন তাকে অক্ষম করে ফেলেছিল। 
শংকা ও নিরাশার সাথে মনিবের খুব কাছাকাছি এসে বসে অসহায়ভাবে তার দিকে দেখছিল। তীব্র শোক তাকে আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলেছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সে এইখানে মনিবের পাশেই থাকতে এসেছিল আর তার পাশ থেকে যেতে যাচ্ছিল না। যে মনিব ছিল তার ভরসার স্থল এবং অন্যভুবনের সাথে তার বন্ধন সেতো মারা গিয়েছিল। 
দুজন গ্রাম্য কয়লা শ্রমিক তাদের কাঁধে থাকা বড় কুঠার নিয়ে দূর থেকে মাখমাল, শুকনো ওকগাছটা এবং মৃত মনিবের দিকে এগিয়ে আসছিল। মাখমাল তাদের দেখে ভীষণ ভয় পেল। কিন্তু তার মনিব তার পাশেই ছিল। কাকতির সাথে মনিবের লাশের দিকে তাকাল সে এবং নিজের গলার ভেতর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কয়েকটি শব্দ করল। তার শরীর কাঁপছিল। 
সে না ছিল মানুষের মতো মানুষ আর না ছিল বানরের মতো বানর। এই দুইয়ের মাঝামাঝি রূপান্তরিত একটা সত্তা ছিল। মানুষের সাথে অধিক ওঠাবসার কারণে তাদেরই একজন হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তাদের পৃথিবীতে তার জায়গা ছিল না। মানুষদের ভালো করে চিনেছিল। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলছিল কুঠারওয়ালারা তাকে নিশ্চিহ্ন করতেই এসেছে। আবারও শিথিল হয়ে যাওয়া শীতল মৃত মনিবের দিকে তাকাল সে। তারপর হাতটা বাড়িয়ে তার পোশাকের প্রান্ত ধরে টানল। তার কাছে সাহায্য চাচ্ছিল। কুঠারওয়ালারা যতই তার কাছাকাছি হচ্ছিল ততই তার ভয়, অসহায়ত্ব ও দুরাবস্থা আরও তীব্রতর হচ্ছিল। কয়লা শ্রমিকরা ছিল রূঢ়, বিশৃঙ্খল, কালো, পাষাণহৃদয় এবং ভ্রƒক্ষেপহীন আর তারা উচ্চঃস্বরে হাসছিল। 
কুঠারওয়ালারা কাছাকাছি হচ্ছিল আর কুঠারগুলো রোদে ঝকমক করছিল। মাখমালের আর অপেক্ষা করার জায়গা ছিল না। ওখানেও কোনো জায়গা ছিল না। ওখানেও সুই ফুটিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানেও গলিত তাওয়া ছিল আর তার ওপর অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। দ্রুত পালাতে উদ্যত হলো সে। তার মৃত মনিব আর তার অবয়বের দিকে আসতে থাকা কুঠারওয়ালাদের কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছিল। কিন্তু মোহ আর শিকলের ভার তার শক্তিকে আটকে ধরল আর মারাত্মক আতঙ্কে তাকে স্বস্থানে আটকে রাখল। মনে হচ্ছিল যেন তার লম্বা পেরেকটা মাটিতে পুতে রাখা হয়েছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিল তার মনিব ছোট পাথর দিয়ে সেটাকে মাটির ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন কখনোই এই পেরেকটা মাটি থেকে তোলা হয়নি। যতই হাত ও ঘাড় দিয়ে শিকলটা টানলো, শিকলটা ছিড়ল না। তার পেরেকের রিঙটা  বেহায়া ওকগাছের গুড়ির পেছনে আটকে গিয়েছিল আর নড়ছিল না। 
বিদ্রোহী হয়ে ওঠল সে। পাগলের মতো উবু হয়ে শিকলটা কামড়াতে লাগল এবং সেটাকে তিক্ত ক্রোধে চিবাতে লাগল। তার রিঙগুলো দাঁতের নিচে শব্দ করছিল আর দাঁতগুলোকে ভাঙছিল। 
ক্রোধের আতিশয্যে তার চোখগুলো গোল হয়ে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। সে চোয়ালের যন্ত্রণার কথা ভুলে গিয়ে পাগলের মতো শিকলটা চিবাচ্ছিল। রক্ত আর দাঁতের টুকরোগুলো তার মুখ থেকে তালুসহ বেরিয়ে এসেছিল। সে চিৎকার করছিল আর শূন্যে লাফিয়ে উঠছিল আর তার কণ্ঠনালীতে যন্ত্রণাকাতর শব্দগুলো গরগর করছিল। 
উপত্যকার সব জায়গা থেকে ধোঁয়ার খিলানগুলো ওপরে উঠে যাচ্ছিল। তবে কোনো আগুন দেখা যাচ্ছিল না। ছায়ামূর্তির মতো মানুষগুলো এই ধোঁয়ার পাশে খোঁজাখুঁজি ও খোড়াখুড়ি করছিল। কুঠারওয়ালারা কাছাকাছি হচ্ছিল আর তাদের কুঠারের ধার রোদের ভেতর জ্বলজ্বল করছিল, আর তারা উচ্চৈঃস্বরে হাসছিল। 
 
অনুবাদক পরিচিতি:
শাকির সবুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক শাকির সবুর। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল থানার বাসাইল গ্রামে। মৌলিক গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য ও আধুনিক ফারসি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম বাংলা ও ফারসি উভয় ভাষায়ই অনুবাদ করছেন।২০০৮-এ তিনি ইস্তগাহে গৌরিপুর শিরোনামে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস গৌরিপুর জংশন-এর ফারসি অনুবাদ করেন। ২০১১-তে তার চোখগুলো শিরোনামে সমকালীন ইরানের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক বুজুর্গে আলাভির বিখ্যাত উপন্যাস চাশমহায়াশ-এর বাংলা অনুবাদ করেন। বাংলা ভাষায় অনূদিত এটিই প্রথম কোনো ফারসি উপন্যাস। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ এবং তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। যা ২০১৩-তে প্রকাশিত Poet of Politics - গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৪-তে খোদার চাঁদমুখে চুমু খাও শিরোনামে প্রকাশিত হয় তাঁর অনূদিত ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানের অন্যতম কথাসাহিত্যিক মুস্তাফা মাস্তুর-এর উপন্যাস রুয়ে মাহে খোদাওয়ান্দ রা বেবুস-এর বাংলা অনুবাদ এবং ২০১৫-তে অন্ধ পেঁচা শিরোনামে প্রকাশিত হয় আধুনিক ইরানের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক সাদেক হেদায়াতের কালজয়ী উপন্যাস বুফে কূর-এর বাংলা অনুবাদ এবং ২০১৮ সনে সাদেক হেদায়াতের নির্বাচিত ছোটগল্প শিরোনামে একই লেখকের ১০টি গল্পের অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয়। ২০২০-এ শ্রেষ্ঠ গল্প শিরোনামে প্রকাশিত হয় আধুনিক ফারসি কথাসাহিত্যের আরেক দিকপাল জালালে আলে আহমাদের ১২টি গল্পের বাংলা অনুবাদসংকলন এবং সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা শিরোনামে বর্তমান ইরানের ৫০ জন কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তাঁদের প্রত্যেকের একটি করে কবিতা ও এর বাংলা অনুবাদ সংকলন।এ গ্রন্থটি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ইরান সরকার কর্তৃক ২৯তম ‘ইরান’স ওয়ার্ল্ড বুক অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার অর্জন করে। এ যাবত তাঁর প্রকাশিতগ্রন্থের সংখ্যা ২৯টি। 


 

সর্বশেষ