
অলংকরণ : জীবন শাহ
আমার স্মৃতির পুজো মানে দেশভাগের আগে আমার গ্রামের পুজো। সেটা মহানগরের আলো-বাদ্য-সংগীত-লোকারণ্য- অভিনন্দিত পুজো নয়, শত-প্রতিযোগিতার ‘শ্রেষ্ঠ’, ‘সেরা’, ‘সম্মানিত’ ‘পূজাশ্রী’ ধরনের হাজার পুজো নয়। টিমটিম করা একটিমাত্র পুজো, কিন্তু তাই নিয়েই আমাদের বিপুল উৎসব-উৎসাহ, আনন্দের মাতোয়ারা উচ্ছ্বাস।
বর্ষার শেষ হতেই শিউলির গন্ধে সেই পুজোর অগ্রিম সংবাদ এসে পৌঁছোত, বাগানে দোপাটির বনে ফড়িং আর প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াত, আকাশের সাদা মেঘের টুকরোগুলো ঠিকানাহীন স্বেচ্ছাচারে ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও বা একটু হঠাৎ মেঘলা হয়ে রামধনু উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা জেলার সেই সুদূর গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া আমাদের বংশাই (ভালো নাম বংশী) নদীতে নানা রঙের বাতাস-ভরা পাল তোলা নৌকো আসছে। বেশির ভাগ নানা পসরার নৌকো, কিছু আসছে যাত্রী নিয়ে। কাশফুলে ছেয়ে যাচ্ছে নদীর ধার আর গ্রামের মাঠঘাট।
ওই যে যাত্রীবাহী নৌকোগুলো আসছে নদী বেয়ে, সেই নৌকার সঙ্গে আমাদের গ্রামের পুজোর একটা গভীর সম্বন্ধ ছিল। সেগুলো ছিল গহনার নৌকো, আমরা বলতাম ‘গয়নার নৌকা’। অনেকটা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের মতো। তাতে করে আসতেন শহরে দূর প্রবাসে চাকরি-করা গ্রামের মানুষজন। এই পুজো উপলক্ষ্যে বছরে তাঁদের একটিবার গ্রামে আসা—তাঁরাও উন্মুখ হয়ে থাকতেন এই উপলক্ষ্যটার জন্যে। তখন একটা মোটর লঞ্চ চালু হয়েছে ঢাকা থেকে, কখনও মোটর লঞ্চেও আসতেন তাঁরা। আমরা দৌড়ে দৌড়ে ঘাটে যেতাম লঞ্চ আর গহনার নৌকার সময় বুঝে—দেখি আজকে কারা এল। ওই তো এসেছেন অমুক জ্যাঠামশাই আর তাঁর পরিবার। আহ্, কী সুন্দর পোশাক তাঁদের ছেলেমেয়েদের, তাদের গায়ে শহরের কী চমৎকার গন্ধ, তাদের পোশাক কী সুন্দর, যেন তারা আমাদের গ্রামের কেউ নয়, তারা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে ! এই এলেন আমার নিজের খুড়তুতো দিদি আর জামাইবাবু। এঁরা এলে আমাদের খুশি লাফিয়ে উঠত আকাশে, কারণ জামাইবাবু আমাদের জন্যে নিয়ে আসতেন বই, জামাকাপড়, শহুরে বিস্কুট আর চকোলেট, এবং গ্রামে তখনকার দুর্লভ এক বস্তু, কন্ডেন্স্ড মিলক—তার নাম বোধ হয় ছিল ‘অস্টারমিল্ক’। তিন ফুটো করে সেই ঘন দুধ জামাইবাবু আমাদের হাতে ঢেলে দিয়ে বলতেন, ‘খাও’। আহা, অমৃতের স্বাদ গড়িয়ে যেত আমাদের পাকস্থলী পর্যন্ত।
গ্রামে আমাদের মা-মাসি-পিসিরা অবিশ্যি অনেক আগে থেকেই পুজোর প্রস্তুতি নিতেন। বর্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতাম উঠোনের একধারে শুকনো নারকেলের স্তূপ জমা হচ্ছে। তারপর একদিন একজন-দুজন মুনিস এসে সেগুলো ছাড়িয়ে দিল, ছাড়ানো নারকেল বারান্দায় তোলা হল। তারপর নারকেল ভাঙার দিন আমাদের ডাক পড়ল নারকেলের জল খাওয়ার জন্যে, আমরা মহানন্দে পেট পুরে নারকেলের জল খাওয়ার উৎসবে মাতলাম। তারপর বাড়ির বউরা কুরুনি নিয়ে বসে সেই নারকেলের করার স্তূপ তৈরি করল থালা বা কলাপাতায়। এবং পরক্ষণেই মা-কাকিমা-বিধবা পিসিরা তার নাড়ু, ‘তক্তি’, সন্দেশ তরি করতে লেগে গেলেন। রান্নাঘর তো নয়, মনোরম ভোজ্য উৎপাদনের কারখানা যেন ! আহা, গরম এখো গুড় আর ভাজা নারকেল-কোরার গন্ধে সারা বাড়িটা ‘ম-ম’ করতে শুরু করল। আমাদের রান্নাঘরের সীমানা ছেড়ে নড়ায় কার সাধ্যি। আমরা যে বঞ্চিত থাকতান তা নয়। পুজোর ভোজ এই তো শুরু হল !
গ্রামের পুজো বারোয়ারি হলেও এক এক বছর এক এক বর্ধিষ্ণু গেরস্থের বাড়িতে পুজো হত। সেখানে মাসখানেক আগে থেকেই দেখতাম প্রতিমার বাঁশ আর কাঠের কাঠামো তরি হচ্ছে। এক সময় খড় বেঁধে বেঁধে প্রতিমার আদল তৈরি হল, তখন তাকে প্রতিমার কঙ্কালের মতোই লাগত। যদিও বাড়ির কোথাও একটা—শূন্য গোয়ালঘরে বা ঢেঁকিশালায়—একটা পাতলা চটের পর্দা টাঙিয়ে প্রতিমা তৈরি হত, আমাদের তা দেখার কোনো বাধা ছিল না। আমাদের প্রতিমা চোখের সামনেই তৈরি হত, আমাদের কোনো কুমোরটুলি ছিল না। তার পর একদিন খড়ের কাঠামোর ওপর মাটি পড়ত, প্রতিমার নিরাবরণ শরীর দাঁড়াত চোখের সামনে। তাদের মাথার চুলও থাকত না। আর আমাদের প্রতিমা ছিল সপরিবার একই চালচিত্রের নীচে—লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ অসুর সিংহ কেউ আলাদা আলাদা থাকতেন না। ও সব শহুরে কেতা আমাদের গ্রামের কুমোররা তখনও শেখেননি।
তারপর একদিন তাদের ওপর একটা সাদা রঙ পড়ত, এখনকার ভাষায় ‘প্রাইমার’। আস্তে আস্তে অতসীফুলের রঙ দেওয়া হত। ঠোঁটের আর হাতের লাল রঙ, পায়ের আলতা, নখের লাল, কার্তিকের কালো জুতো, গণেশের শুঁড়ের ভাঁজ আর সামনে লাল রঙ,—আস্তে আস্তে দেবদেবীদের মূর্তি ফুটে উঠতে থাকত। তাদের মাথায় কালো রঙ করা শণপাটের চুলও পরানো হত এই সময়। কিন্তু দেবীর ‘চোখ’ আঁকা আমরা দেখতে পেতাম না, বোধ হয় মধ্যরাত্রে পর কুমোর কোনো শুভক্ষণ দেখে দেবীকে ‘চক্ষুদান’ করতেন।
আমরা অধীর অপেক্ষায় থাকতাম কবে স্কুলের ছুটি হবে। আমাদের ধৈর্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে সেই ছুটিটা বোধ হয় হত পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিন। তার পর আমাদের আর পায় কে ? না খেয়ে না দেয় পুজোমণ্ডপে পড়ে থাকার পর্ব শুরু হল। পুজোর ছুটির পরেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা, কিন্তু গুরুজনরা এক স্বর্গীয় উদারতায় বলেই দিতেন পুজোর ক-দিন বই ধরবার দরকার নেই, এমনকি বই ধরলে তা নাকি পাপ। সে পাপ আর কে করতে যায় ! বই না-পড়ার পুণ্যসঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক মহাভোজে অংশগ্রহণ—সকালে লুচি ও নতুন ওঠা ফুলকপির ছেঁচকি, কোনো দিন পিঠে-পায়েস, দুপুরে রাত্রে সপ্তব্যঞ্জন। ভাতে গাওয়া ঘি, প্রচুর ভাজাভুজি, শরতের অজচ্ছল মাছ, নানাবিধ তরকারি, চাটনি, দই, সন্দেশ, এবং নবমীর দিন অবধারিতভাবে নধর খাসির মাংস। এই সব খাবার খাওয়ার জন্যেও আমাদের পুজোমণ্ডপ থেকে বার বার ডাকাডাকি করে টেনে আনতে হত, আমরা খুবই অনিচ্ছাসত্ত্বে বাড়িতে ফিরতাম। এর সঙ্গে যদি বিজয়ার খাদ্য-অভিযানের কথা যোগ করি, তাহলে পাঠকেরা আর আমাকে ক্ষমা করবেন বলে মনে হয় না। আমার পেটের সহনশক্তিও আজকাল আর তেমন নেই।
তখন তো এখনকার মতো ‘জলসা’ ছিল না, অমুক-কণ্ঠী তমুক-কণ্ঠী শিল্পীদেরও উদয় হয়নি আমাদের সাংস্কৃতিক দিগন্তে। পুজোয় ছিল থিয়েটার। গ্রামের দাদা ও কাকারা অনেক আগে থেকেই তার মহড়া শুরু করে দিতেন। বেশিরভাগ সময়েই কলকাতার স্টেজের কোনো সফল নাটক, ‘দেবলাদেবী’, কিংবা ‘সাজাহান’ কিংবা ‘রাতকানা’। আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে রিহার্সাল দেখাবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। ওটা বড়দের ব্যাপার। নায়িকা বা স্ত্রীচরিত্রে পুরুষেরাই অভিনয় করতেন, তাঁদের ভারী গলাকে কীভাবে দুমড়ে-মুচড়ে মেয়েদের মতো মিহি করে ফ্যালবার চেষ্টা করছেন তা দেখে আমাদের হাসি পেত।
এর ফলে যেটা হত, বিজয়া দশমীর বা কালীপূজোর দুদিন পরে যখন সেই থিয়েটার হত তখন অবধারিতভাবে স্ত্রী-অভিনেতাদের দু-একজনের গলা বসে যেত, গলা দিয়ে ফ্যাশফ্যাশ আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোত না। বউদি বা কাকিমারা প্রাণপণ চেষ্টা করতেন আদা-চা করে দিয়ে সেই গলা মেরামত করতে, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো সুরাহা হত না। ফলে থিয়েটারের দিন নায়িকার ভাঙা গলায় ‘প্রাণনাথ’ এবং প্রেমের সংলাপ চ্যাংড়া দর্শকদের মধ্যে মাঝে মধ্যে মৃদু হাসির ঢেউ তুললে, গ্রামের প্রবীণরা বজ্রগম্ভীর স্বরে ধমকে উঠতেন ‘সাইলেন্স !’ বলে। নাটক তবু মুগ্ধ হয়ে দেখত চারপাশের দশখানা গ্রাম থেকে আসা গ্রামের লোক।
এই ছবিটা আমার চোখে এখনও লেগে আছে। দূর গ্রাম থেকে দর্শক এসেভে হারিকেন নিয়ে। সেই হারিকেন নিয়ে তারা নাটকের শেষে দূরের ধানখেতের মাঝখানকার আলপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মাঠের ওপর ভারী হয়ে থাকা অন্ধকার দোলাতে দোলাতে।
তবে এই কাব্যিক দৃশ্যেই আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হত না। একটু অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স যোগ করে বলি, নাটকের শেষে অভিনেতা-‘অভিনেত্রী’ ও অন্যান্য ‘কলাকুশলী’রা এবং গ্রামের লোকেরা রাত বারোটা নাগাদ পুজোবাড়ির দীর্ঘ হ্যাজাক আলোকিত বারান্দায় এক ভোজসভায় পাত পেড়ে বসত। গরম ভাত, মুগডাল, বেগুনভাজা, আলু-ফুলকপির তরকারি আর চর্বিবহুল গরম খাসির মাংসের সদ্ব্যবহার করার জন্যে। তখনকার পুব-বাংলার গ্রামের মানুষ, তারা সে সুখাদ্যের সদ্ব্যবহার করতে ত্রুটি করত না।
ওই থিয়েটারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুজোর রোজনামচায় সে বছরের মতো দাঁড়ি টানতে হত। এর পর সেই অবহেলিত ও অপমানিত বইপত্রের কাছে ফেরবার পালা।
জা,ই