বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ , ১১ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

আমার গুরুগণ: দ্বিতীয় পর্ব : যাঁদের পাখায় আমি পথ চলি

শিল্প-সাহিত্য

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

সর্বশেষ

আমার গুরুগণ: দ্বিতীয় পর্ব : যাঁদের পাখায় আমি পথ চলি

অলংকরণ : জীবন শাহ

করতোয়া শোভাময়ী পৌরাণিক নদী। দ্বিখণ্ডিত করেছো আমায়; ইউ-ট্র‍্যাপের উত্তরে ফুলবাড়ি গ্রামের ডান-কান-ঘেঁষা তোমার জলে নেমেছে মাইনকার খালের স্রোতোধারা--আষাঢ়-শ্রাবণে আমি টের পাই। গ্রামের দক্ষিণে নদীর এপারে ঈদগাহ, ওপারেতে পৌরসভার উত্তরমুখী মহাশ্মশান। ইউ-আকৃতির পেটের মধ্যে ফুলবাড়ির সবুজ ফসলি-ক্ষেত। ফুলবাড়ির বুকচিরে শেরপুর-ঝাঁজোর সংযোগ সড়ক। ডাইনে-বামে চকপাথালিয়া, রানীনগর, দামুয়া, খামারকান্দি, জয়নগর, শিবপুর, ভবানিপুর গ্রাম-সকল; আর দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ। বগুড়া জেলার গাড়িদহ ইউনিয়ন ভৌগোলিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিবেচনায় দেশের অন্যান্য ইউনিয়নই শুধু নয়, যেকোনো পৌর এবং জেলা শহরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই গাড়িদহ ইউনিয়নেই RDA (Rural Development Academy) পল্লী উন্নয়ন একাডেমি অবস্থিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান এই একাডেমি। আর এই কাজটি ত্বরান্বিত করেছিলেন বগুড়া ৫, শেরপুর-ধুনট আসনের আওয়ামী লীগের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আমানুল্লাহ খান। স্কুলের বন্ধুদের কাছে আমার ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক মানের এতবড় স্থাপনা নিয়ে আমার গর্বের সীমা ছিলো না। স্কুলে পড়তেই আমি মাঝে মাঝে দুপুর অথবা বিকেল বেলায় একাডেমির বিশাল লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য সাইকেল চালিয়ে  যেতাম। দুপুরে একাডেমির ক্যান্টিনে পরিচ্ছন্ন উন্নত পরিবেশে খাবার খেতাম। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেবার আগে মূল্য পরিশোধ করে নিজের খাবার নিজেই নিতাম, বিদেশাগত সাহেব ও দেশি কর্মকর্তাদের সাথে। এই প্রক্রিয়ার সাথে প্রথম পরিচিত হলাম--ইংরেজিতে যাকে বলে পে-টু-ডাচ। 

গাড়ীদহ ইউনিয়নের আমার ফুলবাড়ি গ্রামখানি শেরপুর পৌর-শহরের অক্সিজেন-চেম্বার। আমার স্কুলজীবনেই করতোয়া ক্রমশ তার যৌবন হারায়--উজানের বাঁধ, দখল-দূষণ করতোয়ার বিশুষ্কতার অন্যতম প্রধান কারণ। বরষায় করতোয়া ফুসে ওঠে, দুইকুল ভাসায়। স্কুলে যাতায়াতে আমি টের পাই। মাড়ের নৌকায়, সোম-বিষ্যুদ সপ্তাহের দুই হাটবারে কতদিন যে বইপুস্তক ভিজে বাড়ি ফিরে এসেছি তার ইয়ত্তা নাই। এভাবেই চলতে থাকলো আমার হাই-স্কুল-জীবন। 

ক্লাস সিক্সে শেরপুর ডি.জে হাই-স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ফেলে-আসা পুরনো বন্ধুদের ফিরে পেলাম। সেই সঙ্গে যুক্ত হলো সারা শেরপুর উপজেলা থেকে পড়তে আসা আমার নতুন ক্লাসমেটদের। আলাপ-পরিচয়-বন্ধুত্ব-প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক নাতিদীর্ঘ ইতিহাস। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে যখন আমি শেরপুর থানা এবং পৌর-শহরের উলিপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে আসি তখন আমি রীতিমতো গ্রামের বন্ধুদের কাছে হিরো বনে যাই। শহরের স্কুলের খবর করতোয়া নদী পার হয়ে এপারের স্কুলেও ধাক্কা দিতে ছাড়েনি। কেনো আমি গ্রামের স্কুল ছেড়ে উলিপুর স্কুলে ভর্তি হলাম, এই নিয়ে শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকদের মাঝে আলোচনার ঝড় বইতে শুরু করলো; এই ঝড় দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। স্কুলের ম্যানেজমেন্টকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আমি শহরের প্রাইমারি স্কুলে চলে গেলেও স্কুল-প্রাইভেট শেষে বিকেল ও সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসি। আমাদের গ্রামের বিশাল ফুটবল মাঠ ছিলো আমার গড়েওঠার প্রাণকেন্দ্র। আর একটা বিষয় আমি খুব মিস করতে থাকি--আমার চকপাথালিয়া প্রাইমারি স্কুলের পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া মাইনকার খালের ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ। আমার শিশুকালের আনন্দের অন্যতম উপাদান বর্ষাকালে মাইনকার খালের ব্রিজের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার মধুময় দৃশ্য আজো আমার চোখে ভাসে, আমাকে বাংলাদেশের ভরা-বরষার ধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুদূরের টানে।

ক্লাস ফোর পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেও আমি ফাস্ট বয় ছিলাম। আমার বন্ধুদের মধ্যে জাকির, টুকু, বুলু, বকুল, লুতু, নান্টু, আতাউর, জিল্লার, মকিম--এদের কথা খুব মনে হয়। চকপাথালিয়া স্কুলেও আমি ঈর্ষা-প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি একাধিকবার।  ভিলেজ পলিটিক্সের মতো স্কুল-পলিটিক্সের শিকারে পরিণত হয়েছি আমি। আমাদের এলাকায় স্বনামখ্যাত পরিবার গুলোর মধ্যে আমার বাবার বন্ধু, রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী হানিফ ডাক্তারের পরিবার বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এই পরিবার স্বাধীনতার পরে ধনে-জনে-অস্ত্রে-শক্তিতে আমাদের পরিবারের চেয়ে এগিয়ে যায়। জমির মালিকানার বিবেচনায় এরা আমাদের কাছে নস্যি হলেও, শক্তিতে আমরা নগন্য। কারণ আমার বাবাকে সহযোগিতা করার মতো উপযুক্ত বড় পুত্র-সন্তান ছিলো না। আমরা সাত ভাইবোনের মধ্যে আমার বড় তিনবোন। আমার বড়ভাই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী--হাঁটাচলা-লেখাপড়া সবই করতে পারে, কিন্তু পিঠের জন্মগত ভাঁজের জন্য খুব আদর এবং হিশেবের জাঁতাকলে চলতে হতো তাকে। বাবা-মা তাকে ছাড়তেও চায়নি। সব চাপ এসে পড়ে আমার উপর। স্কুলে হানিফ ডাক্তারের নাতিকূলের আক্রোশের শিকার আমি। আমার বন্ধু জাকির স্কুলের ফুটবল  খেলার মাঠে পান থেকে চুন খসতেই আমার হাঁটুর উপর কিক মেরে আহত করতো। টুকু, বকুল, বুলু গায়ে হাত না-তুললেও একপক্ষ হয়ে ভীষণ হট্টগোল বাধিয়ে দিতো। কিল-ঘুষি থেকে উদ্ধারের একমাত্র ত্রাতা ছিলো আমার ইমিডিয়েট বড়বোন উম্মে কুলসুম। আমার এই বোন আমাকে আদর করতো খুব। পিঠেপিঠি ভাই-বোন হওয়াতে ওর সাথে আমার প্রায়ই ঝগড়া বাধতো। ঝগড়া গড়িয়ে হাতাহাতি-কিলঘুষিতে গিয়ে মায়ের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থামতো। আমার বোন উম্মে কুলসুম খুব সহনশীল ও দায়িত্ববান ছিলো। মায়ের কাজে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা ছাড়াও আমার বাবার দিকে খেয়াল রাখতো রীতিমতো। 

আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রচুর ফলগাছ ছিলো। আম-জাম-বেল-পেয়ারা-গাব-গোলাপজাম, ক্ষুদিজাম আরও কত-কী। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা ফলের গন্ধে বাতাস মৌমৌ করতো। আমাদের তিনটা ফলের বাগান ছিলো। দুইটা এজমালি। আর একটা সম্পূর্ণ আমার বাবার একার। আমাদের কাচারিবাড়ির বাগানের আম-কাঁঠালের সুমিষ্ঠতা সর্বজন-নন্দিত। কাচারিবাড়ির একটি কাঁঠাল দুইজন বাঁকে করে নিয়ে আসতো। এই কাঁঠালকে সাইঙ্গা কাঁঠাল বলতো। ফজলি-কাঁচামিঠা-আষাঢ়িয়া আমের স্বাদ ছিলো তুলনারহিত। আমপাকার কালে আমরা মহিষের গাড়ি নিয়ে দশ-বারোজন গেছো শ্রমিক নিয়ে আম পাড়তে যেতাম। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় এদেরকে কামলা বলতো। আম পেড়ে দহপাড়ার সকলকে সাধ্যমতো আম-কাঁঠাল বিতরণ করে যা অবশিষ্ট থাকতো তাই নিয়ে মহিষের গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। আমি ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর থেকেই এই দায়িত্ব পালন করতাম নিষ্ঠার সাথে। আমি নিজেকে রাজা ভাবতাম। খুব এনজয় করতাম এই কাজকে।

(চলবে)

সর্বশেষ