বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ , ১৩ চৈত্র ১৪৩০

modhura
Aporup Bangla

রাজস্ব আয়ের ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দিচ্ছে দক্ষিণ সিটি, জানে না মন্ত্রণালয়

জাতীয়

অপরূপ বাংলা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১১ অক্টোবর ২০২৩

সর্বশেষ

রাজস্ব আয়ের ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দিচ্ছে দক্ষিণ সিটি, জানে না মন্ত্রণালয়

ছবি সংগ্রহ

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংস্থাটি নিজেদের নতুন ওয়েবসাইটে সরাসরি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে আবেদন গ্রহণ ও সনদ বিতরণ করছে। জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণের বাসিন্দাদের ভোগান্তি কমাতে এমন উদ্যোগ ডিএসসিসির।

‘কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটির এ উদ্যোগের আইনি ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। তারা বলছে, বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেওয়ার দায়িত্ব রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের। আর এ কার্যক্রম পরিচালনায় শুধু নিবন্ধকের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এই নিয়মে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সেবা দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের। এখন কোন নিয়মে ডিএসসিসি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন গ্রহণ ও সনদ বিতরণ করছে, তার কিছুই জানে না তারা’

যদিও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের দাবি, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের সার্ভার দিনের অধিকাংশ সময় ডাউন থাকে। এখন সার্ভারে ঢোকা গেলে তো, কিছুক্ষণ পর আবার ঢোকা যায় না। এ কারণে প্রতিদিনি হাজারো মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হতো। এ সমস্যা সমাধানে তাদের বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও সার্ভারের ত্রুটি ঠিক করেনি তারা। তাই যথাযথ নিয়ম মেনেই নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন গ্রহণ এবং সনদ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে যথাযথ নিয়ম বলতে আসলে ডিএসসিসি কী বুঝাতে চাইছে, তার ‘যৌক্তিক’ উত্তর দিতে পারেনি সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে ডিএসসিসি ও রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের দ্বন্দ্বের পেছনে ভিন্ন কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই দুটি সংস্থার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

‘তারা বলছেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন খাত থেকে রাজস্ব আয়ের ভাগ চেয়েছিল ডিএসসিসি। কিন্তু আইনগত সুযোগ না থাকায় অপারগতা প্রকাশ করে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়। প্রতিবাদে চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে আলাদা ১০টি অঞ্চলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল ডিএসসিসি। তাতে কাজ না হওয়ায় কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের নতুন ওয়েবসাইটেই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শুরু করে দেয় সংস্থাটি’

ডিএসসিসির জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন গ্রহণ ও সনদ বিতরণ:

ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর থেকে নিজ ব্যবস্থাপনায় নতুন ওয়েবসাইটে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএসসিসি। নতুন কার্যক্রমের আওতায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সম্পাদন করতে নিবন্ধন সনদ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে ডিএসসিসির ওয়েবসাইট এ প্রবেশ করে ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ আইকনে ক্লিক করতে হবে। এরপর ফরমের তথ্যাদি পূরণ করে অনলাইনেই আবেদন দাখিল করতে হবে। পরবর্তীতে অনলাইনে পূরণকৃত আবেদন প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহকারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে দাখিলপূর্বক জন্ম-মত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে। অথবা সরাসরি এ প্রবেশ করেও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে।

এখন এই নিয়মে ডিএসসিসির পৃথক ১০টি অঞ্চল থেকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০০৪ অনুযায়ী, নির্ধারিত হারে ফি নিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া যথাসময়েই নাগরিকরা সনদ পাচ্ছেন বলেও জানায় তারা। যদিও ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৮৩ হাজার ৩৫ জনকে জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়েছে। একই সময়ে ১ হাজার ৮৪৯ জনকে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দিয়েছে ডিএসসিসি। তবে গত ৪ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত নিজস্ব সার্ভার থেকে ঠিক কত জনকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের  বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভার সারা বছরই ডাউন থাকে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ পেতে নাগরিকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ জন্য ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদেরই গালি দেন নাগরিকরা। তাই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমকে জনবান্ধব ও সহজতর করতে পুরো প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজিয়েছে ডিএসসিসি।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০০৪ এর কোন ধারা অনুযায়ী, ডিএসসিসি সরাসরি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন গ্রহণ এবং সনদ বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে আবু নাছের বলেন, আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশন এলাকায় শিশুদের জন্ম নিবন্ধন এবং নাগরিকদের মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেওয়ার দায়িত্ব নিবন্ধকের তথা সংস্থার মেয়রের। তাই আইন অনুযায়ী ওই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ওয়েবসাইটের তথ্য জাতীয় সার্ভারে তথা রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

অপরদিকে, জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে ডিএসসিসির ওয়েবসাইটের কোনো সংযোগ নেই বলে জানান রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। তিনি  বলেন, ‘ডিএসসিসি নিজেদের ওয়েবসাইটে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শুরু করেছে বলে শুনেছি। কিন্তু এটা আইন বা বিধি সম্মত নয়।’

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফির ভাগ নিয়ে জটিলতা:

আগে জন্ম নিবন্ধনের ফি (৫০ টাকা) হাতে নেওয়া হতো এবং সপ্তাহ শেষে চালান আকারে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতো ডিএসসিসি। আর ফির আরেক অংশ সিটি করপোরেশনের তফসিলভুক্ত আয় হিসেবেই গণ্য করা হতো। গত এপ্রিলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি পরিশোধে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়। এ ই-পেমেন্ট চালু হওয়ায় সব অর্থ সরাসরি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। তখন এই খাতে ডিএসসিসির আয় বন্ধ হয়ে যায়।

ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজে সিটি করপোরেশনের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয়। জনবল, কার্যালয়, সনদের জন্য কাগজ, প্রিন্টিংসহ বিভিন্ন খাতে বছরে এক কোটি টাকার বেশি খরচ রয়েছে। তাই এতদিন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি বাবদ আয়ের একাংশ সিটি করপোরেশনের তফসিলভুক্ত আয় হিসেবেই গণ্য করা হতো। কিন্তু ই-পেমেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য যারা আবেদন করেন, তাদের ফি অনলাইনে মোবাইল ব্যাংকিং হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়।

এরপর ই-পেমেন্টে সব অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস আগেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কাছে আপত্তি জানিয়েছিলেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। পরে মন্ত্রী তার একান্ত সচিব মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকীকে এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন। এ নিয়ে তারা কয়েকবার বৈঠকও করে। কিন্তু সুরাহা হয়নি বিষয়টির।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি সিটি করপোরেশন তফসিলভুক্ত আয় হিসেবেই গণ্য করার আইনগত সুযোগ নেই বলে জানান রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। তিনি জানান, ‘নাগরিকদের সুবিধার জন্য আমরা অনলাইন সেবা চালু করেছি। দেশের সব সিটি করপোরেশন (১২টি), পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি অনলাইনেই নেওয়া হচ্ছে। একমাত্র ডিএসসিসি তা মানতে নারাজ। তারা আগের মতোই চালান আকারে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে চায়।’

সর্বশেষ