মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ , ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

শিক্ষাঙ্গনে কেন প্রশাসন ব্যর্থ

মতামত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

শিক্ষাঙ্গনে কেন প্রশাসন ব্যর্থ

ফাইল ছবি

‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। কারণ বিভিন্ন সময় মাদক, ধর্ষণসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বহিরাগতদের প্রবেশের দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।’

এ কথাগুলো একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার। গত বৃহস্পতিবার র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যারের ফোর্সটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা বলেন।


জাহাঙ্গীরনগর দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে চলছে আবাসনসংকট। শিক্ষাজীবন শেষ হলেও এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী আসন দখল করে থাকছে। তাদের প্রায় সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসন পাচ্ছে না। ঠিক একটি বিষয় থেকেই বোঝা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রশাসন নেই। নামে উপাচার্য, উ-উপাচার্য, প্রক্টর আর রেজিষ্ট্রার সহ কর্মকর্তা আছে ঠিকই, তবে তারা আছেন কেবল চেয়ারে। বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে ছাত্রলীগ।

খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পরিস্থিতি ভয়ংকর। এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো, ডেকে নিয়ে ধর্ষণের প্রস্তাব-হুমকি, সিট বাণিজ্য, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কোন ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছিল। সে নিজেই ছাত্রলীগ নেতা এবং তার প্রভাব ছিল নানা কান্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক), পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটছে। এমনকি অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভয়ে ভুক্তভোগীরাই হল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।


গত বছর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক ছাত্রীকে র‌্যাগিংয়ের নামে বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থী নিজে শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ করলেও প্রক্টর, উপাচার্য কোনো ব্যবস্থা নিতে চাননি। অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে একটা ব্যবস্থা হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বাসই করছে যে হলের রাজা ছাত্রলীগ, বাকিরা প্রজা। হলে সিট পেতে ছাত্রলীগ ভরসা। শুধু তাই নয় ছাত্রলীগের বড় ভাই বা আপাদের কথার বাইরে পা ফেললেই জীবন নাশের শঙ্কা। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি কলেজ রাজার হালে শাসন করছে ছাত্রলীগ আর তাদের তোয়াজ করে চেলেছে এগুলোর প্রশাসন।

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভয়ংকর সব আচরণ নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয়রানি ও নির্যাতন করা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া, কিংবা শিক্ষক ও সাংবাদিকদের ভয় দেখানো— এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে গেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাগামহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন নিয়ে এর কর্মীরা সাধারণ শিক্ষর্থীদের শিক্ষা জীবন নষ্ট করেছে। এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের নেতাকর্মীরা প্রায়শই ধারালো অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে, অবৈধভাবে হলের রুম দখল করে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মারধর করে, ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ভাঙচুর করে, এমনকি শিক্ষকদের হুমকি দেয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও একই চিত্র।

ছাত্রলীগ কেন এমন করে আর শিক্ষকরা কেন এত অসহায়? ছাত্রলীগ তার কর্মীদের কোনো ভাল শিক্ষা আর দেয় না, এটা যেমন সত্যি, তেমনি একথাও ঠিক যে ছাত্রলীগ নেতারা জানে যে তাদের শক্তির ওপর ভর করেই শিক্ষকরা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বা সরকারি পদ পদবী পাচ্ছেন। ফলে নৈতিক জায়গায় নেই শিক্ষকরা। তাছাড়া শিক্ষক রাজনীতি নিজেও এতো নোংরা যে তারা ছাত্রলীগ নেতাদের কিছু বলার মতো নৈতিকতা নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সৃষ্টি করা বিশৃঙ্খলার মূল কারণ এটি। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে,ধর্ষণ কান্ড ঘটছে, পড়ুয়ারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এবং অবশ্যই কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষক-অধ্যাপকরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সবকিছুর কারণ এই ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার নামান্তর।
বাংলাদেশের রাজনীতি যে ক্রমেই বিপরীত মতকে গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে তার প্রশিক্ষণ হচ্ছে ক্যাম্পাসগুলোতে। শাসক দলের ছাত্র সংগঠন যেমন বিরোধী দল বা ভিন্নমতের কাউকে জায়গা দিতে রাজি নয়, শিক্ষক রাজনীতিও সেই চর্চাই করছে। ফলে শিক্ষাঙ্গন শাসন করার নৈতিক মনোবল তারা হারিয়ে ফেলেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের রাজনীতি বহু দিন যাবৎ হিংসাকেন্দ্রিক। এখন শুধু সম্পূর্ণ ধ্বংস দেখার পালা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

জ.ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়