শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ , ১৪ চৈত্র ১৪৩০

modhura
Aporup Bangla

কোন বছরের ১০ ডিসেম্বর?

মতামত

প্রভাষ আমিন

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ১০ অক্টোবর ২০২২

সর্বশেষ

কোন বছরের ১০ ডিসেম্বর?

প্রভাষ আমিন

জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। যদিও দলটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশীদার। একই সঙ্গে সরকারি দলের জোটের সঙ্গে থাকা এবং বিরোধী দল হওয়ার বিরল ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে জাতীয় পার্টি। তবে সাধারণ মানুষের কাছে বিরোধী দল বিএনপিই। দলটি ২০০৬ সালের পর থেকে টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সাধারণ মানুষের বিপুল সমর্থন এখনও বিএনপির প্রতিই।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে নামকাওয়াস্তে অংশ নিলেও তাদের ভরাডুবি হয়। সরকারের দমন-পীড়ন, মামলা-হামলায় বিএনপি অনেকটা দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া দলটির নেতৃত্বেও বড় রকমের সঙ্কট রয়েছে। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দণ্ড নিয়ে এখন সরকারের অনুগ্রহে বাসায় আছেন। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। শুধু জনসমর্থনেই টিকে আছে দলটি।

 বিএনপির আন্দোলন অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের হাসির বিষয় হয়ে আছে। মুক্ত থাকতে বেগম খালেদা জিয়া প্রায়ই ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ডাক দিতেন। কিন্তু সেই কঠোর আন্দোলন আর হতো না। তাই কোন ঈদের পর কঠোর আন্দোলন, এটা ছিল ট্রলের বিষয়। আপাতত আমরা ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করি, দেখি আমান উল্লাহ আমানের ঝুলিতে কোন ট্রাম্প কার্ড আছে। 

দীর্ঘদিন বিএনপি তাদের তৎপরতা ইনডোরে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে ব্রিফিং আর প্রেসক্লাবে সেমিনারই বিএনপিকে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রেখেছিল। সংসদে অনুগত আর বাইরে নির্বিষ বিরোধী দল থাকায় আওয়ামী এককভাবে দেশ চালাচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার কার্যকর বিরোধী দলের অভাবে কথা বলছিলেন। দেশের স্বার্থে, সরকারের স্বার্থেও দেশে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল দরকার। আশার কথা বিএনপি দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও তারা সভা-সমাবেশ নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর মাঠের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ বিএনপিকে আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী করেছে। আর বিএনপির এই আত্মবিশ্বাস শঙ্কার ভাঁিজ ফেলেছে সরকারি দলের কপালে।

মাঠে নেমেই যথারীতি তারা বাধার মুখে পড়েছে। বিভিন্নস্থানে সরকার ও সরকারি দলের হামলার শিকার হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। ভোলা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে প্রাণ গেছে তিনজনের। তবে আগের স্টাইলে বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হচ্ছে, আবার মামলাও হচ্ছে তাদের নামেই। মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপি সরকার বিরোধী সব দলের সাথে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপির লক্ষ্য একটি যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং চলমান আন্দোলনকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেয়া। বিএনপি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। তাদের আকাঙ্খা, সরকার বিরোধী বৃহত্তর এক্য এবং যুগপৎ আন্দোলনে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করা। তাদের আকাঙ্খা পূরণ হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির আকাঙ্খা পূরণের মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

প্রবল গণআন্দোলন ছাড়া বর্তমান সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। বিএনপির নানা কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে বটে, তবে সেটা এখনও সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করার মত পরিস্থিতির দিকে যায়নি।


রাজপথে শক্তিশালী বিরোধী দলের কার্যকর ও সরব উপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলের। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বিএনপি একটু আগেই আন্দোলন শুরু করেছে। নির্বাচনের এখন ১৪ মাস বাকি আছে। অতীত ইতিহাস বলে নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন টেনে নেয়ার সক্ষমতা বিএনপির নেই। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিরোধী দলকে বাধা দেয়া হবে না, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে এলে প্রয়োজনে তাতের চা খাওয়ানো হবে বলা হলেও মাঠে তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং নানা জায়গায় সরকার ও সরকারি দল বিরোধী দলের ওপর হামলা চালিয়েছে।

মাঠ সমান থাকলে শক্তি দিয়েই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতো। কিন্তু সরকারি দলের সাথে পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে। তাই অন্তত গায়ের জোরে বিএনপির পারার কোনো সুযোগ নেই। বরং আগেই শুরু করা আন্দোলনে বিএনপির শক্তিক্ষয় হবে। গত আড়াই মাসের আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীরা নতুন নতুন মামলার আসামী হয়েছেন। যখন সত্যি সত্যি মাঠে থাকার দরকার হবে, তখন দেখা যাবে বিএনপির আন্দোলনের স্ট্রাইকিং ফোর্স হয় কারাগারে, নয় পালিয়ে বেরাচ্ছে। তাই বিএনপি আগে নিজেদের সংগঠন গুছিয়ে, সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে আরো পরে টানা চালিয়ে যাওয়ার মত সক্ষমতা অর্জন করে আন্দোলনে নামা।

আগেই বলেছি, মাঠের কর্মসূচিতে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ বিএনপি নেতাদের আত্মবিশ্বাসী করেছে। আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতি আত্মবিশ্বাস বিপদজনক। গত শনিবার রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও নেতা-কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত জনসভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেছেন, ‘প্রশাসন আজকে নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে, আমরা দেখিয়েছি মাঠ কাদের দখলে। ২০১৪ সালের ভোট ডাকাতি ও ২০১৮ সালের রাতের ভোট আর চলবে না। ২০২২ সালেই শেখ হাসিনার পতন হবে। পুরো ঢাকা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে।’

রাজনীতির মাঠে রাজনীতিবিদদের সব কথা ধরতে নেই। কিন্তু আমান উল্লাহ আমানের মত একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা যখন সরকার পতনের দিন তারিখ উল্লেখ করে দেন, তখন তা আমলে না নিয়ে উপায় নেই। আমান উল্লাহ আমান ডাকসুর সাবেক ভিপি। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেটা তিন দশক আগের কথা। এখন আর আমান উল্লাহ আমানের কথায় ভয় পেয়ে সরকার পতন ঘটে যাবে, মাঠের বাস্তবতা তা নয়।


আমার খালি একটাই প্রশ্ন, ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার পতনের আলটিমেটামের কারণ কী? ১০ ডিসেম্বর কী ঘটবে? শিগগিরই সরকার পতন হবে, এ বছরই হবে, সরকারকে এবার যেতেই হবে- এ ধরনের কথার তবু মানে আছে। কিন্তু ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ খালেদা জিয়ার কথায় চলবে- এর মানেটা কী? পরবর্তী নির্বাচন হবে আগামী বছরের শেষে বা ২০২৪ এর শুরুতে। তাহলে নির্বাচনের একবছর আগে সরকার পতন হবে কোন পন্থায়?

সরকার পতনের এমন তারিখ বেঁধে দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগেও ঘটেছে। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ঘোষণা করেছিলেন, ৩০ এপ্রিল তারিখের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানো হবে। তাঁর হাতে ট্রাম্প কার্ড রয়েছে। তবে সেই বহুল আলোচিত ৩০ এপ্রিলে সরকার পতন তো হয়ইনি, কিছুই ঘটেনি। আব্দুল জলিলের হাতে কী ট্রাম্প কার্ড ছিল তাও আর জানা যায়নি। বরং সেই ট্রাম্প কার্ড তত্ত্ব আব্দুল জলিলকে আলোচিত, সমালোচিত ও ৩০ এপ্রিলের পর হাস্যকর করে তুলেছিল। আমান উল্লাহ আমানের কাছেও কি ১০ ডিসেম্বরের ব্যাপারে গোপন কোনো খবর আছে, নাকি তিনিও নিজেকে এবং বিএনপির চলমান আন্দোলনকে হাস্যকর করে তুলবেন।

বিএনপির আন্দোলন অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের হাসির বিষয় হয়ে আছে। মুক্ত থাকতে বেগম খালেদা জিয়া প্রায়ই ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ডাক দিতেন। কিন্তু সেই কঠোর আন্দোলন আর হতো না। তাই কোন ঈদের পর কঠোর আন্দোলন, এটা ছিল ট্রলের বিষয়। আপাতত আমরা ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করি, দেখি আমান উল্লাহ আমানের ঝুলিতে কোন ট্রাম্প কার্ড আছে। নইলে হয়তো আমান উল্লাহ আমানকেও শুনতে হবে কোন বছরের ১০ ডিসেম্বর সরকার পতন?

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

সর্বশেষ