শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

এ রমজানে কেন নয় মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী!

মতামত

টুটুল রহমান

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ১৬ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

এ রমজানে কেন নয় মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী!

ছবি : প্রতিবেদক

বছরখানেক আগের কথা। ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’- মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন এক বাঘামন্ত্রী। নেট দুনিয়ায় তুলোধুনো হয়েছেন। হাস্যরস  উৎপাদনের পাশাপাশি  রোষেও পরে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তার। এবার তার মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি। কৃষি খাতের ব্যর্থতা নিয়ে হয়তো কৃষিমন্ত্রী একজন কৃষিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তারও জায়গা হয়নি মন্ত্রিসভায়। দিন দশেক আগের কথা। ইফতারে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নাজেহাল এখন শিল্পমন্ত্রী। কবে না জানি বস্ত্র সংশ্লিষ্ট কেউ বলেন, ফুলপ্যান্টের দাম বেশি তাই মানুষেরা হাফ প্যান্ট পরলেই পারে! মন্ত্রীদের এমন মন্তব্য কেউই আশা করে না। আমরা চাই মন্ত্রীরা সমস্যার হাস্যকর বিকল্প প্রস্তাব না করে দায়িত্বশীল সমাধান খুঁজে বের করুক। লোককে আর কতো হাসাবে এরা?

আহসানুল ইসলাম টিটু রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবাকে তো মোটামুটি সবাই চেনে। আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন। হরেক রকম ব্যবসাও ছিল তার। তারই উত্তরসূরি হিসেবে টিটু সে সবের দেখভাল করছেন ভালোই। রাজনীতির রেসে বাবার রেখে যাওয়া নিশানটি আহসান ইসলাম টিটু পেয়েছেন বাংলাদেশের পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে। হ্যাঁ অস্বীকার করার উপায় নেই তারও অনেক যোগ্যতা আছে। বাইরে পড়েছেন। অর্থনীতির জ্ঞান আহরণ করেছেন। শেয়ারবাজারে ভালো একটা নামডাক আছে। এমনকি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো যোগ্য বিবেচনা করেই তাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন। 

নতুন মন্ত্রীদের বাগাড়ম্বর!
যেদিন নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হলো সেদিনের টিভি স্ক্রিনের কথা আমার খুব মনে পড়ছে। মন্ত্রীদের বাগাড়ম্বর আর কথার ফুলকি ছোটানো দেখে আমি হেসে ছিলাম এটাও মনে পড়ছে। মন্ত্রীরা যে যার জায়গা থেকে সব করে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ দেখে দেশবাসীও আশা করেছিল এবার ক্যারিশম্যাটিক কিছু একটা ঘটবে। ৬০ দিন পার হয়েছে নতুন মন্ত্রীদের। কই কোনো কিছু বদলের আভাস কি পাওয়া গেছে? উত্তর হচ্ছে না। দেশ তার ধারাবাহিক যাত্রার ট্রেনই অব্যাহত রেখেছে। কোথাও কোনো নতুনের কেতন উড়তে দেখা যাচ্ছে না। 

এবার আসল কথায় আসি। দ্রব্যমূল্য। এই একটি মাত্র শব্দ গত কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষকে যে কতো ভাবে নাজেহাল করছে তার ইয়ত্তা নেই। মনে হয়, মনে হবে কেন? সত্যি সত্যিই এই দ্রব্যমূল্য শব্দটি দেশের মানুষ হাজার বার উচ্চারণ করছে। অভিশম্পাত দিচ্ছে। করোনামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত, ডলার সংকট, কম উৎপাদন হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সব ধরনের পণ্য এখন এমন লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের সাধ্যে আর কুলাচ্ছে না। তারা টিকতে পারছেন না। প্রতিদিনই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে মরণাপন্নের মতো ভেজাঘাম আর দীর্ঘশ^াস ফেলতে ফেলতে মানুষ এখন ক্লান্ত। বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের ভাষণের মতোই ‘মানুষ এখন মুক্তি চায়। মানুষ এখন বাঁচতে চায়।’ 

মানুষের এই বাঁচার আকুতি পরাজয়ের শব্দ উপরের আরশ কাঁপিয়ে দিলেও এদেশের ব্যবসায়ীদের কান অব্দি পৌঁছায় না। তারা নাকে তেল দিয়ে কুম্ভকর্ণের মতো নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তাদের এই ঘুম ভাঙিয়ে শাসানোর যেন কেউ নেই। এমন কোনো  নিত্যপণ্য নেই যে, তা নিয়ে আমাদের দেশের মহৎ ব্যবসায়ীরা খেলেন নি। জনগণের পকেট কাটেননি। মাঝে মধ্যে  ভোক্তা অধিকারের সীমিত আকারের অভিযানে জরিমানা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই  আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠে ব্যবসায়ীরা। কী এক অদৃশ্য শক্তি তাদের ঠেলে ধরে আছে। তাদের নাড়ানো যায় না, সরানো যায় না, কিছু বলাও যায় না। এ এক ভিন্নতর জগদ্দল পাথর। তেল, চিনি, আটা, পিয়াজ, কাঁচা মরিচ হেন পণ্য নেই যে, যার মাধ্যমে এই ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের পকেট কাটেননি। ভাবা যায় গরুর মাংস খেতে হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। গত বছরের ২০০ টাকার খেজুর এবার ৬০০ টাকাতেও মিলছে না। মনে হচ্ছে খেজুর উৎপন্ন এমন দেশের বাগানগুলো বিরান ভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে। একবার ভাবুন এই পবিত্র রমজানে এই ঐতিহ্যবাহী পণ্যটি না পেয়ে মানুষ কী ধরনের অভিশাপের অনল বর্ষণ করছে। বিদেশি তো বটেই দেশীয় ফলও এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। 

আসুন একটু পরিসংখ্যান দেই নিত্যপণ্যের দামের। 
ফল দিয়ে শুরু করা যাক: পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, রাজধানীর বাদামতলী, কাওরান বাজার, হাতিরপুল, শান্তিনগর, ঝিগাতলা ঘুরে দেখা যায় পাইকারি বাজারে ক্রাউন আপেল ২০ কেজির বক্স বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়। ফলে পাইকারিতে প্রতি কেজি আপেলের দাম পড়ছে ১৯০-২০০ টাকা। খুচরা বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।

ফুজি আপেলের ২০ কেজির বক্স ৪৫০০-৪৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি  কেজি ফুজি আপেলের দাম পাইকারিতে পড়ছে ২২৫-২৩৫ টাকা। খুচরা বাজারে এই আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা।
মিশরের মাল্টা ১৫ কেজির বক্স পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকায় (প্রতি কেজি ১৮৬-১৯০ টাকা)। খুচরা বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা।

ভারতের সাদা আঙ্গুর ছোট ক্যারেট (৯ কেজি) ২১০০  থেকে ২২০০ টাকা, বড় ক্যারেট (৯ কেজি) ৩৮০০ থেকে ৩৯০০ টাকা এবং দেশটির কালো আঙ্গুর ছোট ক্যারেট ৩ হাজার থেকে ৩২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব আঙ্গুর প্রকারভেদে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজিতে। 
এক সপ্তাহের ব্যবধানে আনার ও আঙ্গুর কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের আনারের কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, কালো আঙ্গুরের কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ এবং সাদা আঙ্গুরের কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

চায়না কমলা (৯ কেজি) ১ কার্টন পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮৫০ থেকে ১৯০০-২০০০ টাকায়, কেজি ২০০-২১০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রকারভেদে এ কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। গ্রিন কমলা পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে কেজি ১৫৭ টাকা, খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায়।

রোজায় ইফতারের আরেকটি জনপ্রিয় ফল আনারস। অন্যান্য বছর রসালো এ ফলটি মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও এবার এটিরও দাম বেশি। বড় সাইজের একটি আনারস খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি দামে। একই আনারস এক বছর আগে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মাঝারি ও ছোট আকারের আনারসের পিস বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।

এদিকে দেশি ফল পাকা কলার ডজন আট-দশ দিন আগেও কেনা গেছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, এখন ডজনে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। চম্পা কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। সবরি কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকার মতো বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

গ্রীষ্মের ফল তরমুজের বেচাকেনাও শুরু হয়েছে অল্প পরিসরে। বিক্রেতারা প্রতি কেজির দর রাখছেন ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। সেই হিসাবে মাঝারি আকারের একটি তরমুজের দাম পড়ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। 
পেয়ারার কেজি সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। বেদানা ৩৫০-৪০০ টাকা, সফেদা/আতাফল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড বরই বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে।

এসবের চেয়ে ইফতারির সবচেয়ে জনপ্রিয় খেজুর কেজিতে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম শুনলে অনেকের শরীর ঘেমে যাচ্ছে। বেগুনের দাম আগেই বাড়ানো হয়েছে। শসা, লেবুর দামও গতবারের তুলনায় অনেক বাড়তি। বাড়তি কাঁচা মরিচ ও ধনে পাতার দামও। 

শরবতের উপকরণের বাজারও গরম
রোজার আগের দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২১০০ টাকায়। যা তিন মাস আগেও বিক্রি হয়েছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া প্রতি কেজি ট্যাং বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়। যা কিছুদিন আগে ছিল ৮০০ টাকা। ৭৫০ গ্রাম ওজনের প্যাকেটজাত ট্যাং আগে বিক্রি হতো ৭৬০ টাকায়। এখন নতুন উৎপাদন করা প্যাকেটের দাম বাড়ানো হয়েছে। ছোট সাইজের  রুহ আফজা ৩০০ মিলিমিটারের দাম আগে ছিল ২১০ টাকা। এখন ২৮০ টাকা করা হয়েছে। বড় সাইজের রুহ আফজা আগে ছিল ৩৫০ টাকা। এখন  বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০  থেকে ৫৫০ টাকায়। এ ছাড়া ইসপি, অরেঞ্জ, ম্যাংগো  ফ্লেভারের বিভিন্ন শরবতের পাউডারের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। 
এই মুহূর্তে বেলের দাম ১ পিস ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা,  লেবুর হালি ৬০ টাকা, পুদিনা পাতা ১০ গ্রাম ৩০ টাকা, ৬  কেজি ওজনের একটি তরমুজ ৫০০ টাকা।

জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির এই তালিকা আরও লম্বা হবে কিন্তু কোনো সমাধান হবে না। গত ১০ই মার্চ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আগামী রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হবে। সরবরাহ চ্যানেলের উন্নতি করে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে তিনি এই কাজটি করবেন। 

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এ বছর কেন কাজটি করা যাচ্ছে না। আপনারা ক্ষমতায়  আছেন ১৫ বছর অথচ সরবরাহ চ্যানেলে কোনো উন্নতি করতে পারেননি। 

লেখক: সম্পাদক, অপরূপ বাংলা

জ. ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়