রোববার, ০৫ মে ২০২৪ , ২১ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

মুজিব সরকার উৎখাতে বামরাজাকারদের ষড়যন্ত্র

মতামত

আবুল খায়ের

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২ ডিসেম্বর ২০২২

সর্বশেষ

মুজিব সরকার উৎখাতে বামরাজাকারদের ষড়যন্ত্র

অলংকরণ : জীবন শাহ

যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ অভিহিত করে ‘নকশাল-রাজাকার ভাই ভাই’ স্লোগান তুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধুঁয়া তুলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে মানবতাবিরোধী নানাবিধ নিকৃষ্ট কুকর্মে রত ছিল তাদেরকেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বামরাজাকার’ বলে সম্বোধন করি। এবং এরাই হচ্ছে বাংলাদেশে চীনাপন্থী নকশাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের এই উগ্রপন্থী দঙ্গলেরা তাদের নেতা চারু মজুমদারের নির্দেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিঃশর্ত সমর্থন প্রদান করে।
দীর্ঘদিন যাবত বামরাজাকারেরা বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল নিয়ে মিথ্যা প্রচারণায় লিপ্ত। স্বাধীনতা উত্তরকালে বামরাজাকারেরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের সরকার উচ্ছেদে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে। এটা অনস্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উচ্ছেদে ১৯৭২ থেকেই বাম রাজাকাররা যে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করে তাতে তারা দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের বিশেষ করে পাকিস্তানিদের সহায়তায় এ কু-কর্মে সফল হয় এবং ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।

 
বিশিষ্ট বামরাজাকার কমরেড আবদুল হক এ কুকর্মে পৌরহিত্য করেন। তার স্যাঙ্গাৎ হিসেবে এ-কুকর্মে যে দলগুলো মালকোঁচা বেধে নেমেছিল তাদের অন্যতম জাসদ ও গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল), আর আবদুল হকের পার্টির নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)’। স্বাধীন বাংলাদেশ অথচ আবদুল হকের মালিকানায় পার্টির নাম পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এবং ১৯৭৬ সন পর্যন্ত দলটি এনামেই অস্তিত্বশীল ছিল। পরবর্তীকালে নাম পাল্টে রাখে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)। হাল আমলে প্রায় অস্তিত্বহীন সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলটি ডজনখানেক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একটির নাম পাওয়া যায় ‘নিউ বিপ্লব কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)’।  
স্বাধীন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ বিষয়ে ১৯৭৪-এ ভুট্টোকে লেখা এক চিঠিতে আবদুল হক নিজ আক্ষেপ প্রকাশ করে চরমপন্থী নকশালদের সাধের পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চেয়ে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন। তাতে আবদুল হক ভুট্টোর নিকট অস্ত্র ও সৈন্যবল সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং পুনরায় সাধের অখ- পাকিস্তান কায়েম করবার মনোবাঞ্ছা তুলে ধরেন। (সূত্রঃ স্ট্যানলি ওলপার্ট লিখিত গ্রন্থ ‘জুলফি ভুট্টো ইন পাকিস্তান।’)
অপরদিকে জাসদ উগ্র ভারত বিরোধীতার নামে ভারত বিদ্বেষী প্রচারণায় এমন মাত্রায় মেতে ওঠে যেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নয়, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের খুন করে কেন্দ্রীয় কমিটি দখল করে তা এক সদস্য বিশিষ্ট করে নিজ মালিকানায় নিয়ে নেন সর্বহারা পার্টির একচ্ছত্র অধিপতি, খুনী, সর্বব্যাপী ব্যাভিচারে মত্ত ফ্যাসিস্ট সিরাজ সিকদার। যার দলের কাজ ছিল একটাই- ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে কী করে থানা লুট, ফাড়ি লুট, পাটের গুদামে আগুন আর জাতীয় শত্রু খতমের নামে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গুম করা খুন করা যায়। ইত্যাকার অপকর্ম করে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সরকারকে অস্থিতিশীল করতে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে সিরাজ সিকদারের মালিকানাধীন সর্বহারা পার্টি।
কথিত আছে যখন চট্টগ্রামে মতান্তরে টেকনাফে সিরাজ সিকদার ধরা পড়েছিল তখন তার স্যুটকেস ভর্তি ছিল ডলার। এদের কর্মকা-ে এটা সুস্পষ্ট যে, এই সকল ইতর বিপ্লবীরা মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র, বিপ্লববাদ, সাম্যবাদ, মাওবাদ ইত্যাকার বাদের নামে ষাটের দশকের প্রারম্ভে সিআইএ’র চালু করা প্রোজেক্ট ‘লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা ঠেকাও’ কর্মসূচী বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল।
১৯৬৭-তে মূল ইপিসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্তির পর থেকে নক্সালপন্থীদের একটাই টার্গেট ছিল আর সেটা হচ্ছে ‘শ্রেণী শত্রু’ বা ‘জাতীয় শত্রু’ খতম করার নামে ‘ট্রু ন্যাশনালিস্ট’দের তথা মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের খতম করা, কতল করা। পরম নিষ্ঠার সাথে লেগে থেকে বিরতীহীনভাবে সারা দেশব্যাপী এরা এ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে গেছে ১৯৭৫ সন পর্যন্ত এবং অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে এই সকল দঙ্গল ভাড়াটে খুনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের চরমপন্থাকে দেশের মানুষ অভিহিত করেছিল ‘গলাকাটা রাজনীতি’ বলে। 
মুজিব সরকারকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক পন্থায় উৎখাত ও জেনারেলদ্বয় ক্ষমতায় আসার পরপরই নিজদের কর্মসূচী যেহেতু বাস্তবায়িত হয়ে গেছে; সুতরাং, নেতৃস্থানীয় শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ আর সমর্থবানেরা পার্টি-ফার্টি বিলুপ্ত অথবা খ-ীকৃত করে বিশেষ সংস্থার সহায়তায় জাসদ, সর্বহারা আর তথাকথিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা ইউরোপ এবং মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছে। অর্থাৎ জাগার মাল জাগায় গিয়ে উঠেছে।
অপরদিকে এঁটো-কাটার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাদবাকীরা হয় বিএনপি-জামাত অথবা জাতীয় পার্টিতে কেউ কেউ স্বল্প মূল্যে কেউ-বা আবার চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। উপরোল্লিখিত চরম প্রতিক্রিয়াশীল অতিবিপ্লবী পেটিবুর্জোয়া রোমান্টিক এইসব দঙ্গলদের জন্ম থেকে অদ্যাবধি একটাই আরাধ্য কাজ যা তারা পরম নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, আর তা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মুজিব ও আওয়ামী লীগের উঠোন চষে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারের পত্তন বাড়ানো। এই কুকর্মে বাম রাজাকারেরা মতাদর্শিক ক্ষেত্র তৈরী করতে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিব সরকার বিরোধী প্রচুর সাহিত্যকর্ম তৈরী করে প্রচার-প্রোপাগান্ডা সংগঠিত করে ভালো সাফল্য পেয়েছে। 
বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল সম্পর্কে সীমাহীন মিথ্যা প্রচারণা। এই প্রচারণা গোয়েবলসীয় প্রচারণাকেও হার মানিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রচারণার এবংবিধ কুকর্মে যারা পৌরহিত্য করেছেন তাদের অন্যতম আইয়ুব খানের মৌলিক স্পীকার জব্বার খানের কুপুত্র প্রয়াত এনায়েত উল্লাহ খান, সাদেক খান অন্যতম। এছাড়া আরো রয়েছে আহমদ ছফা, শাহাদাত চৌধুরী, আহমেদ মুসা প্রমুখ। এদের মৌল আলোচ্য বিষয়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর চারিত্র-বৈশিষ্ট্যকে কলুষিত করণ, সচেতনভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষাড়যন্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ চালানো। এনায়েতউল্লাহ খান, সাদেক খান, শাহাদাত চৌধুরী, আহমেদ হুমায়ুন, আহমেদ ছফা, আহমেদ মুসা সহ তাবৎ বুরবকের দল হলিডে, বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে লাগাতার এসব কুকর্মে লিপ্ত ছিল। দেশের স্বল্প শিক্ষিত সহজ মানুষদের বোকা বানানোর মতলবে এসকল দঙ্গল বাকশাল সম্পর্কে একটিই প্রচারণা সর্বব্যাপী করে তুলেছিল আর তা হচ্ছে, ‘মুজিব, আমরণ প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য এই ব্যবস্থা করেছে’ আর ‘মুজিবের মৃত্যুর পর তার ছেলে বা বংশধরদের মনোনীত কেউ না কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবে’ এবং ‘মুজিব দেশে রাজতন্ত্র কায়েম করছে’ ইত্যাদি। এই মিথ্যা প্রচারণাটি অতিবিপ্লবী দঙ্গলদের সকলেই ফেরী করে বেড়িয়েছে। ‘গেরাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ করাবার অভিপ্রায়ে ব্যর্থ দঙ্গলটির মনোভাব ছিল অনেকটা এরকম ‘অভিলাষী মন চন্দ্র না পাক’ ষড়যন্ত্রে ‘পাক সামান্য ঠাঁই।’
সশস্ত্র বিপ্লবের ফেরিওয়ালাদের তত্ত্ব থেকে ’৭১-এর গেরিলা কায়দার দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিপ্লবটি হস্তচ্যুত হয়ে তা মুজিবের হস্তগত হওয়ায় আব্দুল হক ও তদীয় দোসর বদ. উমর মুজিবের উপর যার পর নাই ক্ষিপ্ত ছিলেন। উপরন্তু, বিপ্লব নামক এই মহার্ঘ্য বস্তটি যারা জন্ম থেকেই ইজারা নিয়েছেন সেই সব অতিবিপ্লবী সৈয়দ বংশধরদের হস্তচ্যুত হয়ে বিপ্লব চলে যাবে ফরিদপুরের জনৈক সেরেস্তাদারের ছেলের হাতে। এ অসহ্য! আব্দুল হক পীর বাড়ীর বনেদী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। আর বদ উমর! ওরে ব্বাপ! সৈয়দ বংশের সন্তান। খোদ কুরাইশ বংশ। উপায় আছে। সুদূর মক্কা থেকে যার পূর্ব পুরুষ উটের দড়ি সম্বল করে এদেশে হিজরত করেছিলেন। তাদের বাদ দিয়ে বিপ্লব চলে যাবে মুজিব-তাজউদ্দীন এদের দখলে। এটি কোনভাবেই তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। 
উপরন্তু, এই কাজে সহায়তা করছে পৌত্তলিক কাফের হিন্দুস্থান। সুতরাং, এবার স্বাধীন বাংলাদেশে যেভাবে যে করেই হোক মুজিব সরকারকে উৎখাত করতেই হবে। ব্যাস, নাম ভিন্ন থাকলে কী হবে এই ইস্যুতে বামরাজাকার ও রাজাকারেরা এক কাট্টা হয়ে নেমে পড়লো এবং কামিয়াব হলো!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানপন্থী নকশাল নেতা আবদুল হক ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে জামাই আদরে থাকতেন। বদ. উমর গ্রাম্য মৌলভীর বেশে ঢাকা শহরেই বহাল তবিয়তে চলাফেরা করতেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষ বিশেষ তত্ত্বীয় কুকর্মে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধারা বদরুদ্দীন উমরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল চাঁদনী ঘাট এলাকায় শাস্তি দিতে। পিতা আবুল হাশিমের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর কৃপায় সে যাত্রায় উমরের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর হক, তোয়াহা, আলাউদ্দীন আর ভাষা মতিনদের গলাকাটা হত্যার রাজনীতির কারণে এরা সকলেই হয় মুজিব নতুবা তাজউদ্দীনকে ধরে জীবন রক্ষা করেছেন। জীবন থেকে রক্ষা পেছেন ‘উপকারীরে বাঘে খায়’, ‘বাঙালী যে পাতে খায় সে পাতে হাগে’ এসব প্রবচন প্রমাণে এরা মেতে উঠিছিল মুজিব নিধনে। 
কামিয়াব হয়েছে বটে! তবে তা সাময়িক। মুজিবকে মেরেছে ঠিকই, কিন্তু মুজিবের চেতনা ও দলটিকে মারতে পারেনি। জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক শক্তিশালী এটা প্রমাণ করে মুজিবের প্রতিষ্ঠিত দল ঠিকই টিকে আছে; পক্ষান্তরে বাম রাজাকাররা চক্রান্ত করে, ষড়যন্ত্র করে, জেনারেলদের শয্যাসঙ্গী হয়ে, তাদের পদলেহন করে, পার্টিকে শতধা বিভক্ত করে, চেতনার চাড়া খাপছাড়া করে ঝুলে আছে উল্টো হয়ে শূন্যে। এখন না আছে পার্টি, না আছে তত্ত্ব! আছে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, অক্ষম পিঁচুটি!

লেখক: গবেষক ও প্রকাশক
[email protected]
 

জা,ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়