বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ , ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

রফিকউল্লাহ খানের প্রবন্ধ ‘চিরকালের বাঁশি’

শিল্প-সাহিত্য

প্রকাশিত: ১৭:২০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৭:২৮, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

রফিকউল্লাহ খানের প্রবন্ধ ‘চিরকালের বাঁশি’

ছবি : সংগ্রহ

মিথ এবং শিল্পের ইতিহাসে বাঁশির ভূমিকা বৈচিত্রময় ও বহুমাত্রিক। প্রাচীন গ্রিক মিথ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের পুরাণ-ইতিহাসের বিস্তৃত পরিসরে মানুষের বিশ্বাস, জীবনাচার ও ধর্মবিশ্বাসে বাঁশি এক সত্তাময় অনুষঙ্গ হিসেবে প্রাক্-ঐতিহাসিক কাল থেকেই বিরাজমান। প্রেম ও বিরহের দুর্দমনীয় অভিঘাতে মানবজীবনের আনন্দ-বেদনাময় অনুভূতির প্রকাশমাধ্যম হিসেবে রূপকথা, লোককাহিনী, লোকপুরাণ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় (genre) বাঁশির অনিঃশেষ ভূমিকার কথা আমরা জানি। বিশেষ করে কবিতা ও সঙ্গীতে বাঁশির বহুমুখী প্রয়োগ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতাড়িত যান্ত্রিক মনকেও আলোড়িত ও স্মৃতিবিধুর করে তোলে। কেবল প্রেম কিংবা বিরহ নয়, নিঃসঙ্গ অস্তিত্বের ঐকান্তিক বেদনা কিংবা শূন্য-অস্তিত্বের মৃত্যুমুখ যন্ত্রণার ব্যাখ্যাতীত অনুভূতিলোকেও অবচেতনে সংগুপ্ত অথবা কবিতায় গানে বিধৃত বাঁশি সহচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বর্তমান কালে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের আবিশ^ বিস্তারের পটভূমিকায় বাঁশির সুমধুর ধ্বনি শোনার আর অবকাশ নেই। আমেরিকা-ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়ার মহাকাশে এখন শুধু ভয়ঙ্কর যুদ্ধ-বিমানের তা-ব, গর্জন। নিভৃতচারী নির্জনবাসী একান্ত বেদনাময় জীবনও এখন আর নিরাপদ নয়। আত্মরক্ষাকামী মানুষের হাতে এখন সুরেলা বাঁশির পরিবর্তে মারণাস্ত্র শোভা পাচ্ছে। বোমা ও বন্ধুকের বীভৎস, বিকট শব্দপ্রবাহ নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির বুকে আতঙ্কের ঝড় তুলছে। সতেজ, সজীব নিসর্গলোক অবিরত হয়ে পড়ছে লন্ডভন্ড, বিদীর্ণ। এ অবস্থায় কোন নিঃসঙ্গ, যন্ত্রণাদগ্ধ নায়িকা বিরহী প্রেমিকের বাঁশির স্বর শুনে বলবে- ‘কেনা বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে’?
   তবুও মানুষের সংবেদনশীল মন এক ‘সুদূর বিপুল’- কে আকর্ষণের তীব্র বাসনায় প্রত্মস্মৃতিলোক কিংবা বিপন্ন, রক্তাক্ত বর্তমান থেকে মুক্তির আকুলতায় চিরায়ত বংশীধ্বনির আশ্রয় সন্ধান করে। বিচিত্র তার রূপ, বিচিত্র তার গতি-প্রকৃতি। নগরায়ণ, যন্ত্রায়ন ও শিল্পায়নের সর্বগ্রাসী বিশ^স্বভাবের মধ্যে বসেও ব্যক্তির নির্জন বেদনাবিধুর মনোলোকে মিথ, পুরাণ কিংবা কবিতা ও গানের ভুবন থেকে ভেসে আসে বিচিত্র সব বাঁশির সুর। কখনো অর্ফিয়াসের ঘুম পারানিয়া মহাবংশীধ্বনি কখনো-বা সহজিয়া অনুরাগে জাগ্রত মনে ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’। শিল্পরস-পিপাসু মন এভাবেই নিজের মতো করে এক বাঁশির জগৎ সৃষ্টি করে।
   ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলাভাষী ভূখ-ের কবিতা ও গানে বাঁশির ব্যবহার বিচিত্র, বহুবর্ণিল। বুড় চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের একটি খ-ের নাম ‘বংশীখ-’। কেবল আদি মধ্যযুগের সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবেই নয়, লোকায়ত বাঙালি জীবনের প্রেম ও বিরহবোধের অসাধারণ আলেখ্য হিসেবে বংশীখ- অতুলীয়। পরবর্তীকালে রচিত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’তে অপেক্ষাকৃত পরিশীলিত যে প্রেম-বিরহস্পন্দিত বাঁশির সুর শোনা যায়, সেখানে চিরকালীন মানবমনের শূন্যতা, আর্তি ও বেদনাবোধের বিন্যাস ঘটেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা ও কৃষ্ণের আচার-আচরণ ও উচ্চারণ অপরিশীলিত গ্রাম্য লোকজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাঁশির অধরা সুরলহরী কোনো নির্দিষ্ট সময়খ-ে আবদ্ধ না থেকে চিরকালের মানবমনে আবেদন সৃষ্টি করে। যমুনা-নদীর তীরে কে একজন বাঁশি বাজাচ্ছে, তা শুনে রাধিকার পরান আকুল হয়, মনে জন্মে ব্যাকুলতা; আর সে বলে- ‘বাঁশির শব্দে মোঁ আউলাইলো রান্ধন।’ নিঃসঙ্গ বিরহিনী চিত্তে বাঁশির প্রতিক্রিয়ার এক অসাধারণ লোকচিত্র। ‘বৈষ্ণব পদাবলী’তে আমরা দেখি বাঁশির বিচিত্র ব্যবহার এবং প্রেমময় চিত্তে তার প্রতিক্রিয়ার বহুমুখী রূপ-রূপান্তর। একজন আধুনিক কবির অনুভবে বৈষ্ণবীয় রসলোক কতোটা শিল্পশীলিত ও অসীমস্পর্শী রূপ লাভ করতে পারে, তার একটি দৃষ্টান্ত :
        শুন, সখি, বাজই বাঁশি।
শশিকরবিহ্বল নিখিল শূন্যতল        এক হরষরসরাশি।
দক্ষিণপবনবিচঞ্চল তরুগণ,        চঞ্চল যমুনাবারি।
কুসুমসুবাস উদার ভইল সখি        উদাস হৃদয় হমারি।
বিগলিত মরম, চরণ-খলিতগতি,    শরম ভরম গয়ি দূর।
নয়ন বারিভর, গরগর অন্তর,        হৃদয় পুলক পরিপূর।
কহ সখি, কহ সখি, মিনতি রাখ সখি,    সো কি হমারি শ্যাম ॥
গগনে গগনে ধ্বনিছে বাঁশরি        সো কি হমারি নাম।
ব্রজের ভাষাকে উনিশ শতকে এভাবেই আধুনিক মনের সমীপবর্তী রূপ দিয়েছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ। ১২৯১ বঙ্গাব্দে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে একুশটি গান সম্বলিত যে বই প্রকাশ করেন, তাতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মিথকে নবজন্ম দান করেন। এবং কৃষ্ণের বাঁশির অনুষঙ্গে নির্দিষ্ট সময়খ-ের প্রেম-ব্যাকুলতাকে চিরকালের করে তোলেন। এর প্রায় দুই যুগ পূর্বে প্রথম আধুনিক বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রাধা-কৃষ্ণের মিথকেই ব্রজাঙ্গনা কাব্যে (১৮৬১ খ্রি:) সমকালীন চেতনার রঙে রঞ্জিত করলেন। কাব্যের শুরুতেই সেই বাঁশির চিরকালীন সুরলহরী:
    নাচিছে কদম্বমূলে,
        বাজায়ে মুরলী, রে,
    রাধিকারমণ!
    চল, সখি, ত্বরা করি,
দেখিগে প্রাণের হরি,
ব্রজের রতন!
চাতকী আমি স্বজনী,
    শুনি জলধরধ্বনি
কেমনে ধৈরজ ধরি থাকি লো এখন?

মধুসূদন পরিণত বয়সে তাঁর ক্লাসিক মনের অন্তরালে মুক্তিপাগল রোম্যান্টিক সত্তাকে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মেনে ধরলেন ব্রজাঙ্গনায়। আর যৌবনোচ্ছল পরিপূর্ণ রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে কৃষ্ণের বাঁশির সুরের জগতে অবগাহন করে নবজন্ম লাভ করলেন :
১.    গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে
বিসরি ত্রাস লোকলাজে সজনি, আও আওলো ॥
২.    বাজাও রে মোহন বাঁশি
সারা দিবসক     বিরহদহনদুখ
মরমক তিয়াষ নাশি ॥

রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে এই বাঁশি বিচিত্র রূপ, রস, সুর ও ব্যঞ্জনায়, সীমা-অসীমের মিলনসাধনার শিল্পসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। তাঁর অনন্তমুখী, বিপুল সুদূরের আশ্রয়-প্রত্যাশী মন বাঁশির অধরা সুর-মাধুর্যের মাধ্যমে অসীমকে স্পর্শ করেছেÑ
    ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে,
    আমি কেন একলা বসে এই বিজনে ॥

এর সমান্তরালে লোকপুরাণের গহ্বর থেকে তুলে এনেছেন চিরকালের প্রেমের প্রতীক-মূর্তিÑ
    এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছিÑ
    মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি ॥
    শুনেছি মূরতি কালো তারে না দেখা ভালো
    সখী, বলো আমি জল আনিতে যমুনায় যাব কি ॥

কবির বাঁশির সুর কেবল অধরাই থাকে না, কখনো কখনো শরীরী সত্তায়ও রূপ নেয় :
    আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি।
        আনন্দে বিষাদে মন উদাসী ॥
    পুষ্প বিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পূরে
        কী মাধুরী সুগন্ধ বাতাসে যায় ভাসি ॥

কবিচিত্ত এবং বাঁশি এক সময় হয়ে ওঠে অভিন্ন :
    আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে ॥
        ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা,
কেবল বলে গেলাম বাঁশির কানে কানে ॥

আধুনিক মনের নিঃসঙ্গ, বেদনাহত, যন্ত্রণাদগ্ধ ভুবনে বাঁশির এই নিভৃত সুরতরঙ্গ কখনো কখনো সঙ্গ-অনুভবের সহায়ক হয়ে ওঠে।    
   আমাদের লোকজীবন এখন যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট, যমুনার কোল পলি আর বালিতে হারিয়েছে তার অঙ্গসৌরভ। তার কূলে আর বাজেনা মোহন বাঁশি। কিন্তু আমাদের হৃদয়যমুনার কূলে কোন্ অচেনা পথিক এখনো বাঁশি বাজায় আমাদের আনন্দ-বেদনার অধরা লোকে। কবির কণ্ঠে শুনি-ে“ওই বুঝি বাঁশি বাজে-/ বনমাঝে কি মনোমাঝে ॥’ অথবা “ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিনী বাজে শেষের রাতে।” মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে বাঁশির সুর একাত্ম হয়ে যায়। কোন্ বাঁশির সুরে কবির এই আকুলতা?
    এবার    নীরব করে দাও হে তোমার মুখর করিবে।
    তার    হৃদয়বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে ॥
        নিশীথরাতের নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পূরে,
যে তান দিয়ে অবাক কর গ্রহশশীরে ॥

এই বাঁশির সুর সীমার সঙ্গে অসীমের মিলনের, এই বাঁশি চিরকালের।



ভিন্নতর সামাজিক-রাজনৈতিক ও বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে বাঁশিরও চরিত্রবদল ঘটে; সুললিত, কোমল ও মোহময় স্বভাবধর্ম রেখে সময়ের প্রয়োজনে সে হয়ে ওঠে অগ্নি-বীণা কিংবা বিষের বাঁশী। এই বাঁশি সংগ্রামের, এই বাঁশি সমাজবদলের। এ কি থেকে বিচার করলে বাংলা কবিতা ও গানের ভুবনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব সকল অর্থেই বিস্ময়কর ও কালদুর্লভ। এতকাল বাংলা কবিতা ও গানে বাঁশির যে সুর শুনে আমরা অভ্যস্ত, প্রথম বিশ^যুদ্ধের ডঙ্কানিনাদে তার ধরনের (Paradigm) ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেল। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তায় বাঁশি কেবল তার ভূগোলকেই অতিক্রম করে গেল না; সুর সংযোগেও ঘটে গেল অভাবনীয় পরিবর্তন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তাঁর বাঁশির ভিন্ন এক চরিত্ররূপে দেখা দিল :
আমি   অর্ফিয়াসের বাঁশরী
মহা-    সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
                       ঘুম                চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশে^ নিঝঝুম
কবির বাঁশি কেবল বিশ^যোগেই যুক্ত হলো না, বাঁশির প্রচলিত স্বভাবকেও সে অতিক্রম করে গেল। কবিতার  পরবর্তী দুই চরণে তার প্রভাব সুস্পষ্ট :
মম     বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি    শ্যামের হাতের বাঁশরী।
বাংলা কবিতা ও গানে কাজী নজরুল ইসলামের বাঁশির সুর-ঝংকার যে বিস্ময়কর নতুনত্ব বয়ে আনলো, কালের বিচারে তার মূল্য অপরিসীম। তিনি অগ্নি-বীণা-র ‘বিদ্রোহী’ কিংবা বিষের বাঁশী-তে নবযুগের বাঁশির যে সুর বাজালেন, তাঁর প্রেম-বিরহ ও ব্যর্থতাবোধের অপার বেদনানন্দময় কবিতা ও গানেও সেই সেই পরিবর্তনের সুরলহরি সুদূরপ্রসারী চারিত্রধর্ম অর্জন করলো। গভীর ভাবময় ও অশরীরী কিংবা পুরাণের জগত থেকে তাঁর বাঁশির জায়গা হলো মানবিক শরীরী প্রেমাকাক্সক্ষাময় জগতেÑ যেখানে রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক প্রেমলোকের অনুষঙ্গও বিশ শতকের মানবীয় জীবনাকাক্সক্ষার সমান্তরাল হয়ে ওঠে।  পৌরাণিক প্রেমলোকের স্মরণ সত্ত্বেও বিরহবেদনার ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও বাঁশির ভূমিকাকে নতুন তাৎপর্যে উপস্থাপন করলেন কবি। বাঁশি হয়ে উঠলো সর্বব্যাপ্ত হাহাকারের রূপ ও রূপক:
ও   পদ্মারে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধূয়ার রূপ তেমনি ঝিলমিল করে কৃষ্ণ-কালো
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস্ তারে, দিস্ এই পদ্ম তার পায়
বলিস্ কেন বুকে আশার দেয়ালী জালিয়ে
 ফেলে গেল চির-অন্ধকারে।

এভাবেই নজরুল বাঁশির ব্যবহারকে জাগতিক প্রেম ও ব্যর্থতাবোধের সঙ্গে সমীকৃত করলেন। তাঁর অসংখ্য গানে বাঁশি মানবিক জীবনের সমান্তরাল হয়ে বাঙালির হৃদয়কে বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত ও আন্দোলিত করেছে। ভারতীয় পুরাণ, বাঙালি পুরাণ এবং বিশ^ পুরাণের বাঁশির যে আবেদন, সেগুলোকে ছাড়িয়ে নজরুলের বাঁশি বেজে উঠলো লোকজীবনের চেনা জগতে:
 কে বিদেশী বন-উদাসী
বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে?
সুর-সোহাগে তন্দ্রা লাগে
কুসুমবাগের গুল-বদনে ॥
...  ... ... ...
সহসা জাগি আধেক রাতে
শুনি সে বাঁশি বাজে হিয়াতে
বাহু-সিথানে কেন কে জানে
কাঁদে গো পিয়া বাঁশীর সনে ॥
বৃথাই গাঁথি কথার মালা
লুকাস কবি বুকের জ¦ালা
কাঁদে নিরালা বনশীওয়ালা
 তোরি উতালা বিরহী মনে ॥
এখানে কবিমনের সঙ্গে বংশীবাদকের সম-উপস্থাপনায় (ঔীঁঃধঢ়ড়ংবফ) বাঁশির আবেদন আমাদের জীবন, প্রকৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।

  নজরুলের কালে বাংলা কবিতা ও গানের যে নবজারণ সূচিত হলো, তার আবেদন হলো বহুমাত্রিক। লোকগানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাঙালি জীবনে সবকালেই ছিলো। সেই চিরায়ত বাঁশির সঙ্গে সহজিয়া প্রেম-অনুরাগ মিলেমিশে যে সুর-তরঙ্গ সৃষ্টি করলো, বাঙালির পরবর্তী জীবনধারায় তার আবেদন হলো অনিঃশেষ। এ ক্ষেত্রে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতা ও গানে পল্লিবাংলার সহজিয়া প্রেম-বিরহ ও বেদনার করুণ গাথায় অপরূপ ব্যঞ্জনায় রূপ পেয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কালজয়ী আখ্যানকাব্য নকশী কাঁথার মাঠ-এ বাঁশি একটি চরিত্রে পরিণত হয়েছে। সাজু-রূপাইয়ের বিরহ-করুণ প্রেমের প্রকৃতি ও পরিণতি চিরকালীন বাংলার রূপককথা (অষষবমড়ৎু)। গ্রাম্য বিবাদের পরিণামে দেশান্তরী রূপাই চিরসঙ্গী বাঁশির রূপ ধরেই তার জন্মস্থানে ফিরে আসে- কিন্তু সেখানে মৃত সাজুর নকশী কাঁথা রূপ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। চেতন-অবচেতনে গ্রামের মানুষ গভীর রাতে কখনো কখনো বেদনাকরুণ বাঁশির সুর শুনতে পায়:
বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
   শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশি বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
                                     রোগ পা-ুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!
 বাঁশির প্রতীকেই জসীমউদ্দীন সাজু-রূপাই-এর প্রেমকথাকে অমরত¦ দান করেন:
 কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,-
মহাশূন্যেতে উড়িয়াছে কেবা নকশী কাথাটি ধরে;
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটিবাজায় করুণ সুরে,
তারি ঢেউ লাগি এ-গাও ও-গাও গহন ব্যথায় ঝুরে।
 লোকজীবনের সহজতা এবং মাটি ও মানুষের অনাবিল জীবনরূপ জসীমউদ্দীনের গানের বিষয়বস্তু। বাংলার লোকসঙ্গীতের জগতে যা অতুলনীয়। তাঁর অনুভবে বাঁশি বালুচরের আনন্দ-বেদনার সঙ্গী:
বাঁশিটি আমার হারায়ে গিয়েছে 
বালুর চরে,
 কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া
গাঁয়ের ঘরে।

 কোমল তৃণের পরশ লাগিয়া,
পায়ের নুপুর পড়েছে খসিয়া
চলিতে চরণ ওঠে না বাজিয়া
 তেমন করে।
পুরাণ-অনুষঙ্গ তাঁর গানে ভিন্ন রূপ পায়। সহজ মনের আকুলতায় বিষয়, সুর ও ছন্দে জাগে নতুন দোলা:
ও মোহন বাঁশি!
বাজাও বাজাও রে কানাই!
ধীরে অতি ধীরে;
আমি জল আনিতে যমুনাতে,
ও বাঁশি শুনব ফিরে ফিরে রে কানাই!
ধীরে অতি ধীরে।
কলসী ভরাব ছলে, 
তোমার ছায়া দেখব জলেরে কানাই
আমি হারায়েনূপুর,
ও ঘরে নাহি নাহি যাব ফিরেরে কানাই।
ধীরে অতি ধীরে।...


নজরুলের অব্যবহিত সময়প্রবাহে বাঁশির যে রূপবদল, তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাঙলির সঙ্গীতরুচি ও শিল্পসাধনাকে নতুন অভূতপূর্ব ভাবলোকে  পৌঁছে দেয়। এ সময়ের গানের কবিরা বাংলা গানের জগতে নিত্য নতুন বাঁশির সংযোজন ঘটালেন। মীরা দেববর্মণ রচিত একটি গান শচীন দেববর্মণের কণ্ঠে বাঁশির মতো কণ্ঠে বেজে উঠলো :
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই
                                                     সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি॥
 সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে
রাত্তিরে তো কথা নাই।
ডাকাতিয়া বাঁশি
...  ... ... ...
ও  ... বাঁশেতে ঘুণ ধরে যদি
 কেন বাঁশিতে ঘুণ ধরে না
কত জনায় মরে শুধু
 পোড়া বাঁশি কেন মরে না॥
সহজিয়া বাঁশি এখানে অন্য স্বভাবে আত্মপ্রকাশ করলো। মীরা দেববর্মণের লেখা আরেকটি অসাধারণ গান- যার সুরকার ও শিল্পী সেই শচীন দেববর্মণ :
ও...ও বাঁশি
ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও বাঁশি
আল্লাহ’র দোহায়,
এ পরানের বিনিময়ে তোমার পরান দিও হাসি
আল্লাহ’র দোহায়॥

ও...ও বাঁশি
বানের টানে টানে আইসো আমার পানে
মধু লাগাইও মনে
মজিও পানের গুণে আসিও
আমার রঙে পানের রঙে রাঙা হইও বাঁশি
আল্লাহ’র দোহায়॥ ...
এ গানের বাণী অতিক্রম করে যায় সকল সহজিয়া গানের ধাঁচ ও ধারা। বাঁশি এখানে রূপময় ও সত্তাময় হয়ে উঠেছে। প্রায় অভিন্ন সময়ে রচিত সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে অনবদ্য একটি গান- যেখানে চিরচেনা বাস্তবের প্রেক্ষাপটে আধুনিক মনে পুরাণের যেন জন্মান্তর ঘটে:
ও বাঁশি হায়
বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়
 কে গেছে হারায়ে, স্মরণের বেদনায়
 কেন মনে এনে দেয়
বাঁশি কেন গায়

ও  বাঁশি
কখনো আনন্দ ছিল জীবনের ছন্দে
হৃদয় মাতাল হত ফাগুনের গন্ধে
 সে গেল কোথায়?
আমি বা কোথায়?
যদি না জানা
 বাঁশি কেন গায়

ও  বাঁশি
তমাল কদম্ব আমার গোপিনী সখিনী
যমুনা উজান গেছে আর তো দেখিনী
সবই যদি যায় 
ধুলিতে মিলায়
তবু কেন হায় 
বাঁশি  কেন গায়
এ বাঁশি আধুনিক মনের আর্ত হাহাকারের সমান্তরাল হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন সুরে ও মেজাজে এ বাঁশি বাজতে থাকবে অনন্তকাল ধরে! কারণ, এ বাঁশি চিরকালের।


 

সর্বশেষ