রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ , ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

বিশেষ সাক্ষাৎকারে দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক আবুল বাশার

বই বিক্রির সঙ্গে সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক নেই

শিল্প-সাহিত্য

অপরূপ বাংলা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮:২১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

বই বিক্রির সঙ্গে সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক নেই

সাহিত্যিক আবুল বাশার

প্রশ্ন:  আপনার গল্প-উপন্যাসে আরবমরুর লোককল্প, আরবি উপকথা ঘুরেফিরে আসে। এ সব জানলেন কোথায়, কীভাবে, কবে থেকে?
আবুল বাশার: ছোটবেলা থেকেই। দাদি, নানির মুখে শুনেছি। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তির থেকেও শোনা। আরবি লোককথাগুলো যেখানে-যেখানে ইসলাম গেছে, ছড়িয়ে পড়েছে। ওই লোককল্পর সঙ্গে ধর্মের উচ্চ চিন্তা যুক্ত আছে। আরবভূমির প্রতিটি বালিকণার গায়ে জড়িয়ে আছে গল্পগুলো। একই গল্প ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, কোরানে পাওয়া যাবে।
প্র: যেমন?
উ: যেমন ধরো, কোরানে আছে উটের নবি সালেহ, ইউরোপীয় পণ্ডিতের লেখায় পড়ছি, উটের আছেন এক দেবতা। গল্পটা এরকম, উটের নবি বা দেবতা সব সময় উটের পিঠেই থাকতেন। ওঁর যখন মৃত্যু হল, সাড়ে তিন হাত জমি পেলেন না। উটের পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হল মৃতদেহ। উট ওঁর মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল এক মরুপাহাড়ের আড়ালে। আড়াই দিন পর যখন ফিরে এল, দেখা গেল উটের পিঠের উপর একটা কুঁজ তৈরি হয়েছে। তার আগে উটেদের পিঠে কুঁজ ছিল না। ওটা হল সেই নবির কবর। আমার গল্পের মূল বিষয়ভাবনা হচ্ছে, ভালমানুষ, নেকদার মানুষ এখানে জায়গা পায় না। এইসব কথা নিয়ে আমার উপন্যাস ‘মরুস্বর্গ’। কাহিনিটা আমি পঁচিশ বছর ধরে মাথায় নিয়ে ঘুরেছি। গল্পগুলি যেমন শুনেছি, হুবহু লিখিনি। নানারকম পুনর্গঠন করেছি। তার সঙ্গে ইতিহাস যুক্ত হয়েছে।
প্র: আপনার লেখালিখিতে কোন শিল্পমাধ্যমের প্রভাব সবচেয়ে বেশি?
উ: সংগীতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও চিত্রকলার প্রভাব আছে। আমরা তো শব্দ দিয়ে লিখি না, ধ্বনি দিয়ে লিখি। গদ্যকে দিয়ে গান গাওয়ানোর প্রয়াস। সংগীতের জ্ঞান যত স্বচ্ছ হবে, সৃষ্টি হবে ধ্বনিরস। আমি তো গান চালিয়ে লেখার কাজ করি।
প্র: মূলত কোন ধরনের গান পছন্দ করেন?
উ: সব ধরনের। এমনকী, গানের সঙ্গে নাচও পছন্দ করি। আগে তো সব একসঙ্গেই ছিল। সংগীতশালা, নাট্যশালা। অভিনেত্রী সাধনার শরীরে লতা মঙ্গেশকরের গান কীরকম দৃশ্যকাব্য সৃষ্টি করছে, তা আমি লক্ষ করি।
প্র: আপনার লেখায় পেয়েছি, কোথায় যেন সুরই ধর্মকে মেলায়।
উ: একদম। ‘সুরের সাম্পান’ উপন্যাসে আমার বিষয় ছিল ওটাই। উচ্চাঙ্গ সংগীতের উৎসটা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত একটা রূপ। উপন্যাসটা যখন পুজোসংখ্যায় ছাপা হচ্ছে, রমাপদ চৌধুরী বলেছিলেন, জার্মান ভাষায় এরকম একটা উপন্যাস আছে। নামটাও বলেছিলেন, এখন ভুলে গেছি। সেখানে দু’টি জাতির উৎস অন্বেষণ করছেন লেখক। সুরের দিক দিয়ে বিচার করলে তারা একই জাতির লোক। রমাপদবাবু বললেন, আপনার উপন্যাসটা ওই উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সুরের সাম্পান-এ সেই ঐক্যটা আমি দেখিয়েছি।
প্র: আপনার লেখায় যৌনতা বিষয় হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায়। এবং সেই যৌনতা পাঠককে প্রলুব্ধ করার জন্য নয়। যৌনতা মানুষের অস্তিত্বের বড় একটা অংশ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
উ: এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথের কাছে যৌনতা ভাইটাল ছিল। তিনি তাঁর মতো করে দেখিয়েছেন। আমি আমার মতো। দু’জনের সময়টা আলাদা। যৌনতার ব্যাপারটা শিখেছি রবীন্দ্রনাথের থেকেই। যৌনতাই আসলে মানুষের আদিম অস্তিত্ব। চালিকাশক্তি। যৌনতাকে এড়িয়ে তো মানুষ হয় না।
প্র: রবীন্দ্রনাথের সেরকম কিছু লেখার কয়েকটা উদাহরণ দিন।
উ: অনেক আছে। যেমন ধরো, ‘চোখের বালি’, ‘শেষের কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘চার অধ্যায়’, ‘নষ্টনীড়’, ‘ঘরে বাইরে’। এ ছাড়া ‘কড়ি ও কোমল’-এর কবিতাগুলোয় দেখো। ‘ঘরে বাইরে’ তো যৌনতানির্ভর উপন্যাস। তার সঙ্গে মিশে আছে স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা। যৌনতা জটিল হয়েছে আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণে। নারীমনের মুক্তির কথা যৌনতার পথ ধরে আসছে। তার নানারকম রূপবৈচিত্র আছে। যুগে-যুগে তা বদলাচ্ছে। এই যেমন আমার ‘মরুস্বর্গ’-র কথা বলছি, সেখানে নায়িকা একটি, নায়ক তিনটি। তিনজনেই নায়িকার সঙ্গে কোনও-না-কোনওভাবে যুক্ত। কামনার দিক থেকেও। তিনটি নায়কই কিন্তু কামনা করছে রিবিকাকে, বিভিন্ন রূপে। আমার বেশির ভাগ লেখাই নায়িকাপ্রধান, এর একটা প্রবণতা আমার লেখায় আছে। নারীজীবনের যৌনতায় ঝোঁক আছে আমার। সেটা যদি আমি দেখাতে পারি, তা হলে তার স্বাধীন সত্তাকেও তুলে ধরতে পারব। তার ভিতরটাকে আবিষ্কার করতে পারব।
প্র: অবদমন তো তাদের উপরই বেশি।
উ: অবদমন তাদের উপর বেশি। ‘ফুলবউ’-ও তাই। ওটা যৌনতারই এক ধরনের কাহিনি। পুরুষতন্ত্র তো যৌনদাসী করে রাখতে চেয়েছে মেয়েদের। যৌনদাসত্ব থেকে মুক্তি আজও মেয়েরা পায়নি। ‘ফুলবউ’-এ তাই, ‘মরুস্বর্গ’-তেও। যদিও মরুস্বর্গ-র নায়িকা ভাষার জন্য লড়াই করছে। ধর্মের জন্য করছে। বাই দ্য বাই বলি, আমাকে সাগরদা [সাগরময় ঘোষ] বলেছিলেন, এই যে মরুস্বর্গ তুমি লিখলে, এটা বছর তিরিশ পরে পাঠকরা বুঝতে পারবে। তাই হয়েছে। মরুস্বর্গ এখন এম এ-তে পড়ানো হয়, ফুলবউ-ও হয়।
প্র: আপনার উপন্যাস ‘নরম হৃদয়ের চিহ্ন’ যৌনতাকে নিয়ে গেছে গবেষণার স্তরে। এখানে সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা নিয়ে বিশদে বলা হয়েছে।
উ: হ্যাঁ, এখন এই বিষয়টা সমাজ-আলোচনার উপরের অংশে চলে এসেছে। কিন্তু আমি যে-সময়ে লিখেছিলাম, সম্ভবত ১৯৯৯ সালে, বিষয়টা এতটাই সাহসী ছিল, পুজোসংখ্যায় ছাপার ঝুঁকি নিতে চাননি পত্রিকার সম্পাদক। ওটা সরাসরি বই হয়ে বেরোয়। সেই প্রকাশনাও হারিয়ে গেল। পরে ওটা ‘দশটি উপন্যাস’-এর সংকলনে রাখেন বাদলদা [বাদল বসু]। বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন তো, বুঝেছিলেন বিষয়টা সমাজে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। উপন্যাসটা লেখার জন্য আমি দু’জন ডাক্তারবাবুর সাহায্য নিয়েছি। শুধুমাত্র সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা নয়, ওখানে কান্তিবিদ্যা নিয়েও লিখেছি।
প্র: কান্তিবিদ্যা বলতে?
উ: শরীরের যেসব অসম্পূর্ণতা, তাকে ডাক্তারবাবুরা ছুরি-কাঁচি ছাড়াও আনুষঙ্গিক চিকিৎসায় দূর করছেন, সেটাকে আমি ‘কান্তিবিদ্যা’ বলছি। ‘কান্তি’ বলতে আমি সৌন্দর্য বোঝাচ্ছি। এই শব্দটা আমিই প্রথম ব্যবহার করি। এখন অনেকেই করে। সোর্সটা ভুলে গেছে। যেমন হয় আর কী! ঈশ্বরের অসম্পূর্ণ কাজটাকে ডাক্তাররা সম্পূর্ণ করছেন, এটাকে আমি ‘কান্তিবিদ্যা’ বলছি।
প্র: আপনার চেতনা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি?
উ: বাবা। বাবা কলিমউদ্দিন আহমেদ সেনাবাহিনীর অফিসে চাকরি করতেন। এক হাতে বন্দুক চালাতে পারতেন। করাচিতে পোস্টিং ছিল, পঞ্জাবে ট্রেজ়ারি অফিসে কাজ করেছেন। অনেকগুলো ভাষা জানতেন, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, পুশতু, ইংরেজি। বাবার থেকে হিন্দি শিখেছিলাম বলেই মাড়োয়ারি দুই কন্যাকে বাংলা ইংরেজি পড়াতে পারতাম। ওরা হিন্দিটা বুঝত। বাজারদরের তুলনায় মাইনেটা তাই বেশি পেতাম। বাবা আমাদের করাচি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। দাদিমা, মানে ঠাকুরমা যেতে দেননি। বাবা পরে ফিরে এসে গ্রামে শিক্ষকতা করতেন। আমার দাদিমা লোকগায়িকা ছিলেন। ঠাকুরদা ছন্দ্‌গান করতেন। এটা মুর্শিদাবাদের লোকগান। শিল্পী গান বাঁধেন, সুর দেন নিজেই। পরিবারের এই সাংস্কৃতিক পরিবেশ আমার উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। আমার মা জহুরা খাতুন। শুক্রগ্রহকে জহুরা নক্ষত্র বলে। আমার উপর মায়ের প্রভাবও ছিল।
প্র: ‘ফুলবউ’-এর পর থেকে আপনার গদ্যভাষা কি ক্রমশ কঠিন হয়ে গেল না? ফুলবউ তো বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ওই ভাষা-আঙ্গিকে থিতু হতে পারতেন।
উ: সেটা উপন্যাসের বিষয়ের কারণে হয়েছে। যেমন, মরুস্বর্গ উপন্যাসের বিষয়টাই এমন, মানুষের ভাষাসমস্যা, ধর্মসমস্যা, যেটা নিয়ে গোটা পৃথিবী পীড়িত। লেখাটি যে-চিত্রময় এবং কাব্যময় ভাষায় বলা হয়েছে, ওভাবে না বললে ওই অভিঘাত হত না। ফুলবউ খুব চেনা জগতের ছবি, তাই বাংলার হিন্দু-মুসলিম সহজেই রিলেট করতে পারে। ফুলবউ-এ একটা ইউনিক স্টোরি আছে। সুগঠিত একটা গল্প। এক ধরনের পাঠক আছেন, যাঁরা এতে স্বস্তি বোধ করেন। সাহিত্যে অনেকসময় দেখা গেছে, গল্প প্রায় নেই বললেই চলে। ভাবনার পরিমাণ বেশি। তার উৎকর্ষ খুব। একজন লেখক যেমন সাধারণ পাঠকের কথাও ভাববেন, তেমন তিনি অগ্রসর পাঠকের কথাও ভাববেন। অগ্রসর পাঠক শুধু গল্পে সন্তুষ্ট হন না। তাঁর আরও কিছু চাই, চিন্তামূলক কিছু চাই। সেই জন্য হল কী, আমার সাধারণ পাঠক কিছু কমে গেল। অগ্রসর পাঠক কিন্তু বাড়ল। যত সময় গেছে অগ্রসর পাঠক বেড়েছে।
প্র: আপনি নিশ্চয়ই অগ্রসর পাঠক পছন্দ করেন?
উ: হ্যাঁ, ওঁরাই তো নির্ধারণ করেন সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি। সাধারণ পাঠক লেখককে বাঁচিয়ে রাখায় খুব সুবিধে করেন। বই বিক্রি হয়, আর্থিক সুবিধে হয়। সেইদিক থেকে সাধারণ পাঠকের কাছে লেখক সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ। কিন্তু লেখকের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করেন অগ্রসর পাঠক।
প্র: তার মানে কি, যে-সাহিত্য বেশি বিক্রি হয়, তা নিম্নমানের?
উ: বিক্রির সঙ্গে সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক নেই। এখন বিক্রি না হলেও পরে বিখ্যাত হয়। সময় গেলে দাম বাড়তে থাকে। এরকম ঘটনা তো আকছার ঘটেছে। জীবনানন্দের কথাই যদি ধরি, একসময় কে জানত তাঁকে? বুঝতেও চাওয়া হয়নি। আর এখন তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কবিতার আলোচনা তো করাই যাবে না। এই যেমন বাহান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়স অবধি রবীন্দ্রনাথের কোনও স্থায়ী পাবলিশার-ই ছিল না। তাৎক্ষণিক বিক্রি দিয়ে কিছু নির্ধারিত হবে না। তবু বিক্রি হোক, এটা লেখক চাইবেনই... কিন্তু বিষয়বস্তু যদি এমন হয়, যা এর আগে কেউ স্পর্শ করেনি? প্রকাশক আমাকে বললেন, তুমি স্পর্শ করো সাহস করে। আমি সেই চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করব। আমি মনে করি আজ না হয় কাল পাঠক এটা পড়বে। তারপর সে নিয়ে যাবে সাধারণের কাছে। যেমন ধরো, আরবি ছন্দ নিয়ে উপন্যাস আছে আমার, ‘দশ পারা’। বছরদুয়েক আগে লিখেছি। কোরানে যে-ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ছন্দ নিয়ে উপন্যাস। ওর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছন্দও মিশে আছে। আমি যদি ভাবতাম শুধু ছন্দ নিয়ে উপন্যাস, কে পড়বে! উপন্যাসটা তা হলে লেখাই হত না।

[সাহিত্যিক আবুল বাশারের সাক্ষাৎকার, দেশ ২০১৯]

জ.ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়