বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ , ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প

শিল্প-সাহিত্য

এমরান কবির

প্রকাশিত: ১৬:০৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প

চিত্র: রনি বর্মন

খবরগুলো কীভাবে যেন চাউর হয়ে যায়। মাত্র একজনের সাথে শেয়ার করেছি বিষয়টি। কয়েক ঘণ্টাও হয়নি। এরই মধ্যে দুইজন সম্পাদক ফোন করে বসলেন। তাও সাহিত্য সম্পাদক কিংবা ফিচার সম্পাদক নন। খোদ সম্পাদক।  আমি নাকি নাকফুল নিয়ে একটি গল্প লিখছি। সেই গল্প তাদের চাই-ই চাই।
এদেশের দু’তিনটি দৈনিক পত্রিকা তাদের  সাহিত্য পাতা নিয়ে একটু আধটু চিন্তা করে। এরকম একটি দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের সাথে কথাচ্ছলে বলেছিলাম। একটি গল্পের ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 
সম্পাদক সাহেব কোনো ভণিতা রাখলেন না। সরাসরি বললেন, ‘নাম কী দেবেন, ভেবেছেন?’ 
আমি বললাম, ‘গল্পটির নাম হবে বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প।’
নাম বলার পর মনে হলো তিনি সত্যিই রোমাঞ্চিত। সুনিশ্চিত হলাম সাহিত্য সম্পাদকের কথায়। কবির ভাই, গল্পটা কিন্তু আমাকেই দিতে হবে। আপনি অন্যথা করবেন না। 
এই দৈনিক আমাকে খুবই সাপোর্ট দেয়। ফোন করে কোনো বিষয় নিয়ে আলোকপাত করে। আমিও আলোচনা চালিয়ে যাই। আলোচনা শুরুর আগে সাহিত্য সম্পাদক বিনয়ের সাতে বলে, স্যার, রেকর্ড করতে পারি? আমি সানন্দে রাজী হই। কারণ যা বলব তা বাতাসে বিলীন করে দেওয়ার চাইতে কোথায় জমা থাকুক। মহাকালের পৃষ্ঠায় স্থান পাবে কি-না জানি না। কিন্তু সমকালের কোথাও থেকে যাক। তাতে যদি একজন মানুষও প্রভাবিত হয় তাও শান্তি। তাও সাফল্য। তাও আত্মতৃপ্তি। তাই আমি সাহিত্য সম্পাদকের কথায় রাজী হয়ে যাই। পরে তারা লিখিত রূপ নিয়ে আসে আমার কাছে। আমি সাইন করে দেই। পিয়ন আসে না। সাহিত্য সম্পাদক নিজেই আসেন। আর আশ্চর্য! সাইন করার সাথে সাথেই আমার মোবাইলে খুদে বার্তা চলে আসে। আপনার অ্যাকাউন্টে এত টাকা ক্রেডিট হয়েছে।  আমি নিশ্চিত সাহিত্য সম্পাদক তখনও অফিসে পৌঁছায়নি। প্রকাশ হবে তো আরো পরে।
অবশ্য অন্য দৈনিকগুলোও আমাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে। আমার লেখা পাওয়া মানে সাহিত্য সম্পাদকের চাকরি আরো কয়েকমাস স্থায়ী হয়ে যাওয়ার মতো।
কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক মহোদয় যখন নিজেই ফোন করে আমার এখন অব্দি না-লেখা গল্প ‘বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প’  নিয়ে কথা বলেন তখন অবাকই হয়ে যাই। 
কী আছে নাকফুলে? কী আছে বৃষ্টিতে! কী আছে যুগপৎ বৃষ্টি ও নাকফুলে!

দুই
আরেকটি প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক আমার বাসায় এসে হাজির। অনেক আড্ডা। এ কথা সে-কথা দে না বুবু আলাপাতা। উঠি উঠি ভাব করে তিনিও পেড়ে ফেলেন তার আলাপাতার কথা। আমি তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা কায়েস সাহেব বলেন তো, এই নাকফুলের মধ্যে কী আছে? এটা নিয়ে এতো আগ্রহ কেন সবার মধ্যে?’ 
সম্পাদক মহোদয় সরু চোখে তাকান। বলেন, ‘আপনি জানেন না?’ 
আমি তাঁর দিকে নির্বাক চেয়ে থাকি। তিনি হয়তো বুঝতে পারেন আমার অসহায়ত্ব।  ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনার নাকফুল তো ভাইরাল হয়ে গেছে।’
আমি আধা শোয়া হয়ে বসেছিলাম। উঠে বসি এবার।  যে-গল্প লিখিইনি এখনো তা ভাইরাল হয় কীভাবে! সম্পাদক মহোদয় হয়তো বুঝতে পারেন যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘সরি, কবির ভাই। আমরা জানি আপনি ফেসবুক ইউজ করেন না। তাতে কী। আপনার নামে খোলা একটি পেজ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আপনি নাকফুল নিয়ে একটি গল্প লিখছেন। আর অমনি ভাইরাল। কত কথা হচ্ছে এটা নিয়ে!’
‘কী কথা হচ্ছে?’
‘সে-সব নিয়ে আপনার কোনো কাজ নেই। আপনার কাজ হলো লেখা। আমাদের কাজ হলো যথাযথ সম্মান ও সম্মানি দিয়ে লেখা প্রকাশ করা।’


তিন
রাতে ঘুম এলো না। নাকফুলের ভেতরে কী আছে! ফেসবুকে নাকি ভাইরাল হচ্ছে। সম্পাদকরা উঠে পড়ে লেগেছে এই গল্পটি নেওয়ার জন্য। ব্যাপারটা কী। এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে তো আমি গল্প লিখতে ভুলে গেছি। কখন ঘুম এলো বলতে পারি না। স্বপ্নে দেখলাম আমার লেখার টেবিলের সামনে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। সাদাকালো চেকের ফতুয়া পরনে। সাদাকালো চুল। ক্লিন শেভড। চোখে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। আমাকে গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন, ‘কবির সাহেব।’
আমি চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকালাম। চিনতে চেষ্টা করলাম। চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে পড়ছে না।
এবার ধমক দিলেন ভদ্রলোক, ‘কী হলো কবির সাহেব। আপনার সমস্যা কী? আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না কেন?’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘কে আপনি।’
‘আমি আন্্ওয়ার আহমদ। রূপম ও কিছুধ্বনি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। আমাকে একটি গল্প দেয়ার কথা ছিল ত্রিশ বছর আগে গল্পপত্র রূপমের জন্য। নাকফুল নিয়ে লেখা গল্প। আগাম সম্মানি হিসেবে আপনাকে আমি দুই হাজার টাকাও দিয়েছিলাম। আপনি গল্প দেননি। টাকাও ফেরৎ দেননি। অন্য কোনো লেখাও দেননি। ওইসময়ের দুই হাজার টাকার মূল্য এখন কত জানেন?’
টাইম ভ্যালু অব মানি বলে একটা কথা আছে। সূত্র আছে। আমি সে-সূত্র জানি না। আমি এ কথা বলতে চাই। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। নিঃশ^াস বন্ধ হয়ে আসে। আমার ঘুম ভেঙে যায়।
ঘেমে গেছি। মোবাইলে ঘড়ি দেখি। রাত তিনটা আটত্রিশ।
মাথার ভেতরে আন্্ওয়ার আহমদের ধমক। লেখা দেইনি। টাকাও ফেরত দেইনি। খুব বাজে একটা ব্যাপার। একেবারে কেলেঙ্কারি অবস্থা। নাকফুল নিয়ে গল্প লিখতে চেয়ে লিখিনি। টাকা নিয়ে ফেরতও দেইনি। উনি তো বিশ বছর আগে মারা গেছেন। মৃত্যুর পরও ছাড়ছেন না দাবি! উনি যে একরোখা আর স্পষ্টভাষী, না জানি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনে কত কী বলেছেন কতজনের কাছে! 
এখন আমি কী করতে পারি! উনাকে কীভাবে লেখা দেব? টাকাটাই বা পাঠাবো কীভাবে? ওপারে টাকা কিংবা লেখা কীভাবে পাঠানো যায়, আমি জানি না। টাকার পরিমাণটাই বা কীভাবে নির্ধারণ করব?
দুইটা উপায় আছে। মরে গিয়ে মরণোত্তর লেখা দেওয়া। কিন্তু ওইপারের কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে সে-ভরসা পাচ্ছি না। এদিকে ত্রিশ বছর পর দুই হাজার টাকার টাইম ভেলু অব মানি কত হবে কে বলতে পারবে।

চার
বিছানা ছেড়ে উঠলাম। পানি খেলাম। মাথায় নাকফুল নেই। মাথার ভেতরে এখন টাইম ভেলু অব মানি। কে বলতে পারবে? ফোন হাতে নিলাম। ডায়াল নাম্বার থেকে দৈবচয়নের মতো করে একটা নাম্বারে ফোন দিলাম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অপর প্রান্ত থেকে বিরক্তি ও ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘ওই রুস্তমের বাচ্চা কুদ্দুস, এত রাইত্তে ফোন করস ক্যালা? কী হইছে তোর?’
মন খারাপ হয়ে গেল খুব। ফোন কেটে দিয়ে বারান্দায় গেলাম। শেষ প্রহরের শশী আকাশে মন খারাপ করে আলো বিলাচ্ছে। ঢেউয়ের কলসিগুলো ডুবে গেছ্ ে। কেউ দেখছে না চাঁদকে। এজন্য চাঁদেরও মন খারাপ। দু’একটি তারা মিটমিট করছে। ফ্যাকাশে। পুরো আকাশ জুড়ে মন খারাপ মন খারাপ অবস্থা।
আমি  মনে মনে একটি তারাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’
আমাকে তারাটি বলল, ‘আমি নাকফুল।’
‘নাকফুল তো নাকে থাকে। তুমি আকাশে কেন?’
‘আমি আকাশে নই। তোমার বুক পকেটে। পকেটে হাত দিয়ে দেখ।’
পকেটে হাত দিলাম। সত্যি একটা নাকফুল। হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরলাম। স্বল্প চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় চিকচিক করে উঠলো।
বারান্দা থেকে রুমে এলাম। নাকফুলটা টেবিলে রেখে। নিঃসঙ্গ সত্তোরোর্ধ একজন বৃদ্ধের বয়সের ভ্রম ভেবে  আবার বিছানায় গেলাম। 

পাঁচ
কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। এবার দেখি আমার লেখার টেবিলে বসে এক তরুণী পা দোলাচ্ছে। নীল টুকটুক শাড়ী পরনে। তাঁর নাকের নাকফুলটি অন্ধকার রাতের চকচকে তারার মতো জ¦লছে। আমি মুগ্ধ হয়ে পুরো দৃশ্য দেখছি। তরুণী আবৃত্তি করছে, চকচক করলেই সোনা হয় না, তবুও চকচক করে সোনা, মাঝে মাঝে ভুল করে ভালো লাগে নকল গহনা।
নীল শাড়ী পরে একজন তরুণী কবিতা পড়ছে, এ দৃশ্য ভাবলেই তো মন ভালো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু না, উল্টো মন খারাপ হয়ে গেলো। বোধ করি কবিতার কথাগুলোর জন্য। কবিরা এমনও হয়! ছি। 
ঘুম ভেঙে গেলো মেজাজ খারাপ নিয়ে।
ছয়
মন খারাপ থাকলে ভালো লিখতে পারি আমি। সে-কথা আমার পরিবার ভালো করেই জানে। পরিবারে আমি ছাড়া আরও দুইজন সদস্য রয়েছে। একজনকে আমার একান্ত সহকারি বলা যেতে পারে। হাসান কুদ্দুস। আরেকজন বাজার-রান্নাবান্না করে। আবুল কুদ্দুস। দুই কুদ্দুস নিয়ে আমার পরিবার। রক্তের পরিজন বলতে কেউ নেই। সত্তোরোর্ধ এই বৃদ্ধের ওরাই ভরসা।
তিনটা গল্প লিখলাম নাকফুল নিয়ে। প্রথম গল্পটি লিখলাম একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহবধুর নাকফুল হারিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে। এক দুপুরে ঘুম থেকে জেগে গৃহবধু দেখেন নাক থেকে তাঁর নাকফুল উধাও। কোথাও যাননি তিনি, ঘরেই ছিলেন কিন্তু নাকফুল নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলেন না। কাকতালীয়ভাবে তাঁর চাকরিজিবী স্বামী দিনশেষে ঘরে ফিরলেন না। কোথায় গেলেন, কী হলো, কেউ বলতে পারল না। একজন জলজ্যান্ত মানুষ শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। থানা পুলিশ নেতা ফেতা কত কিছু করা হলো। ফলাফল শূন্য। শাশুড়ীর হঠাৎ মনে পড়লো নাকফুল হারানোর কথা। নাকফুল হারানো খুবই অলূক্ষণে ব্যাপার। তিনি পুত্রবধুকে দোষারোপ করতে লাগলেন। একদিন নাকফুল পাওয়া গেলো। তাহলে কি তাঁর স্বামীকেও ফিরে পাওয়া যাবে? এরকম আশা নিরাশা অপেক্ষা আর লোকবিশ^াস নিয়ে লেখা গল্প।
দ্বিতীয় গল্পটি তরুণ তরুণীর বিয়ে নিয়ে। মৃত্যুর আগে মা ছেলের হাতে একটি নাকফুল দিয়ে যান। বলেন, খুব শখ ছিল পুত্রবধূর নাকে তিনি নিজ হাতে পরিয়ে দেবেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সে-সময় তাঁর জন্য বরাদ্দ করেননি।  তিনি চলে গেছেন পরপারে। মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যান বিয়ের আসরে যেন পুত্রবধুকে এই নাকফুল পরানো হয়। মায়ের কথা রাখতে তরুণের পক্ষ থেকে  নাকফুলটি কণেকে পরানোর জন্য দেওয়া হয়। কণে সেটা পরতে অস্বীকার করে। লক্ষ টাকা দামের হীরের নাকফুল বাদ দিয়ে তিনি কেন সেকেলে ওই নাকফুল পরবেন? এটা হতেই পারে না। আর মৃত মায়ের দেয়া নাকফুল  পরতে হবে কেন। এইসব সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি অথবা সংস্কার তাঁর একেবারেই অপছন্দ । বিষয়টি এক পর্যায়ে চরম আকার ধারণ করল। ভেঙে গেল বিয়ে।  চার-পাঁচ বছরের উদ্দাম প্রেমের অসফল পরিণতি হয়ে গেল।
তৃতীয় গল্পটি নাকফুল উপহার পাওয়া নিয়ে। এই শহরে হঠাৎ করে কিছু পুরুষ নাকফুল উপহার পেতে থাকেন। নতুন ফুল বা নতুন পাখি (প্রেম অর্থে) মনে করে তারা আসন্ন আনন্দে মেতে উঠার প্রস্ততি নিতে থাকেন। তাঁদের নতুন প্রেম হয়। এখনকার প্রেমে যা হয় আর কি। বিছানা আর বিছানা। বিশেষ মুহূর্তে তাঁরা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পড়ে যান। নাভির নিচে রক্ত নিয়ে তারা হাঁসপাতালে ভর্তি হন। এবং খুব সতর্কতার সাথে বিষয়টি গোপন করেন। ধীরে ধীরে পুরো শহরে বিষয়টি  গোপনে গোপনে চাউর হয়ে যায়। ফিসফাস হতে থাকে। যে পুরুষদের নুনুভূতি (অনুভূতির অনুরূপ) বেশি এবং যখন তখন সুন্দরী নারী দেখলেই জেগে ওঠে, এবং অতীতে এবং বর্তমানে এর ব্যবহার করতে সচেষ্ট এবং উন্মুখ ছিলেন অথবা আছেন, তারাই নাকফুল উপহার পেতে থাকেন। স্ত্রীরা বিষয়টি জেনে সতর্কতার সাথে পরখ করতে থাকেন তাঁর একান্ত পুরুষধন কোনো নাকফুল উপহার পেলেন কি-না। তাদের পুরুষাঙ্গ ঠিক আছে কি-না। পুরুষরা সন্ত্রস্ত থাকেন। কারণ এখন নাকফুলের পর প্রেম হচ্ছে না। সরাসরি রক্তাক্ত করা হচ্ছে রহস্যজনকভাবে। কখন যে  কে নাকফুল উপহার পেয়ে যান? কে বা কারা এই কাজটি করছে কেউ বুঝতে পারছে না। বিষয়টি অফিসিয়াল অ্যাক্টের ভেতরে কি-না তা নিয়ে কোনো আইনজীবিকে রিট করতেও দেখা যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে একদা ধর্ষক এবং ধর্ষন্নে¥ুখ পুরুষগণ এখন নাকি বিশেষ ন্যাপকিন পরা শুরু করেছেন অধিকতর নিরাপত্তার জন্য।

সাত
লিখে খুব শান্তি পাচ্ছি। আপাতত কেউ ডিসটার্ব করছে না। আমার পরিবারের দুই কুদ্দুসের এক কুদ্দুস এসে জানায়, স্যার, আপনার অ্যাকাউন্টে তিনটা দৈনিকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ক্রেডিট হয়েছে। আমি নিশ্চুপ থাকি। কুদ্দুস টাকার পরিমাণটাও জানায়। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকি। বলে কি! এত টাকা!
আমি কুদ্দুসকে গল্প তিনটা এক ঝুরিতে রাখতে বলি। আর ওদেরকে ফোনে জানাতে বলি। এসে দৈবচয়নের ভিত্তিতে গল্প নিয়ে যাবে।

আট
নীল শাড়ী পরা সেই তরুণীকে আবার দেখা গেল আমার ঘরে। এটা ওটা দেখছে। নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ, কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি আর বকুল ফুলের গন্ধ- ঘরময় ম ম করছে। তরুণী ঘুরতে ঘুরতে আমার লেখার টেবিলে বসে পা দোলাতে লাগল। মিষ্টি কণ্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলো- ‘চকচক করলেই সোনা হয় না, তবুও চকচক করে সোনা, মাঝে মাঝে ভুল করে ভালো লাগে নকল গহনা।’ আবৃত্তি শেষে একটা নাকফুল চোখ বরাবর ধরে দেখল। নাকফুলের পাথরে ডিম লাইটের নীল আলো পড়ায় চিকচিক করে উঠল। আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো।
তরুণী হঠাৎ নাকফুল আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। নাকফুল এসে আমার কপালে আঘাত করল। চিনচিনে ব্যথায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। কপালে হাত দিয়ে দেখি মশা খেয়ে রক্তে ড্যাবড্যাবা। আসলে স্বপ্ন ছিল। বুঝতে পারিনি।
ব্যালকনিতে আসি। শুরু হয়েছে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কালো অন্ধকারের ভেতরে শাদা বৃষ্টি দেখি। শহরের বৃষ্টিগুলো বেদনাবহ। কারণ রিমঝিম শব্দ নেই। গ্রামের বৃষ্ট্গিুলো আনন্দবহ। 
সত্যিই তাই। একদিন এ কথা বলেছিল নাবিলা। তখন মনে হয়নি একথা ঠিক । এখন মনে হয়।
জন্মদিকে আমাকে দেয়া তাঁর শেষ উপহারটি ছিল নাকফুল। হাতে নিয়ে বলেছিলাম, ‘ওমা। এটা আমি কী করব। ব্রেসলেট বা দুলের পর কি এখন ছেলেরা নাকফুলও পরা শুরু করেছে!’
নাবিলা ঠোঁট টিপে হেসেছিল। হাসতে হাসতে কপট রাগ দেখাতে দেখাতে নাকফুলের সাথে আমার হাতে চাপ দিতে দিতে বলেছিল, ‘না।’
আমি ভেবেছিলাম বিয়ের প্রতীক হিসেবে নাবিলা এই কা- করেছে। বিয়ের কথা ইঙ্গিতে জানাচ্ছে।
কিন্তু না। নাবিলা উপহার হিসেবে নাকফুল দিয়েছিল এটা নিয়ে একটা গল্প লেখার জন্য। আর বলেছিল, বৃষ্টিতে ভেজার সময় মুখে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোটাই হচ্ছে আসল নাকফুল। তোমার চোখ যখন পড়বে সেখানে, মনের আয়নায় জ¦লে উঠবে।  এমন করে কবে আমাদের প্রথম বৃষ্টি আসবে ! অনুনয় আর আশঙ্কা ছিল তাঁর সমস্ত হৃদয় জুড়ে। ফলে তাকে দেখাচ্ছিল বিচলিত। বিধ্বস্ত।
তখন থেকেই আমি কল্পনা করতে থাকি ওই নাকফুল নিয়ে। বৃষ্টির ফুল আমার দেখা হয়নি। ইচ্ছে ছিল মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির পর মাটির গন্ধ নাকে মাখতে মাখতে তার নাকে দেখব বৃষ্টির নাকফুল। হয়নি। সে বৃষ্টি এখনো এলো না। গল্পটাও লেখা হয়নি এতদিন। আজ যখন তিন তিনটা গল্প লিখলাম তখন একবারের জন্য হলেও তাঁর কথা মনে আসেনি। গল্প লেখার পর প্রসন্ন চিত্তে যখন ঘুমাতে গিয়েছি তখনই এই স্বপ্ন দেখলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। লেখার পরের তৃপ্তিটুকু উদযাপন করা হলো না।
আজ এত বছর পর যখন নাকফুল নিয়ে গল্প লিখলাম তখন কাকতালীয়ভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর কী পরিহাস, যে আমাকে নাকফুল নিয়ে গল্প লিখতে বলেছিল, তাঁর কথা আমি নির্ঘাৎ ভুলে বসে আছি।
রুমে এলাম। কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দিলাম। বাহিরে বৃষ্টি, ভেতরে সঙ্গীতের ঝরনা ধারা। আবার বুঝি তন্দ্রা এসেছিল! দেখছি সেই তরুণী নীল শাড়ি পড়ে পায়চারি শুরু করেছে ঘরময়। পায়ে নুপুরের ঝনঝন, হাতে কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি,  খোপায় পরা বকুলের সুবাসে ঘরময় ম ম করছে। তরুণী আবৃত্তি করছে, চকচক করলেই সোনা হয় না, তবুও চকচক করে সোনা, খুব ভালো লাগে বৃষ্টির গহনা’।
এরপর বৃষ্টি ভেজা একটি মুখ আমার দিকে ঝুঁকে আসে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। তার চুল বেয়ে পানি টপটপ করে পড়ে আমার চোখ মুখ বুক ভিজে দেয়। তরুণী করুণ কণ্ঠে বলে, ‘যেদিন নাকফুল হারালো, তুমি এলে না, সেদিনও বৃষ্টি ছিল।  তুমি সে-কথা লিখবে না?’

নয়
শুক্রবার সকালে বসে আছি। কোনো ফোন ধরছি না কয়েকদিন ধরে। ভেবেছিলাম আজ থেকে ফোন ধরব। কিন্তু রাতের দু’ দুটো স্বপ্নের কারণে একটুও ভালো লাগছে না।  গল্প লিখলাম ঠিকই নাকফুল নিয়ে। কিন্তু জীবনে যে প্রথম বলেছিল নাকফুল নিয়ে গল্প লিকতে তাঁর কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকলাম। সবকিছু কি আর মনে থাকে? কিন্তু আমার অবচেনতন মন ঠিক স্বপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিলো কিছু কথা, কিছু স্মৃতি। 
বয়স হয়েছে। বিরক্ত লাগছে সব কিছুতে। এদিকে হয়েছে আরেক সমস্যা। চোখ বন্ধ করলেই নীল শাড়ীর নাকফুল এসে কবিতাটা শুনিয়ে যাচ্ছে- চকচক করলেই সোনা হয় না, তবুও চকচক করে সোনা, মাঝে মাঝে ভুল করে ভালো লাগে নকল গহনা।
দুই কুদ্দুসের এক কুদ্দুস এসে আমার সামনে  শুক্রবারের দৈনিক কাগজগুলো মেলে ধরে। 
‘স্যার দেখেছেন?’
আমি কিছু বলি না। চেয়ে থাকি শুধু। কুদ্দুস আমার সামনে তিনটি দৈনিকের সাহিত্য পাতা মেলে ধরে। আমার যৌবনকালের ছবি ছাপা হয়েছে। বুক পকেটে একটি ছিদ্র। সেখানে একটা নাকফুল চকচক করছে। এ ছবি কোথায় পেল ওরা! খুব ভালো ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে। আকর্ষণীয় সব ইলাসট্রেশন। পাশে প্লাটিনাম ওয়ার্ল্ড নামের এক কোম্পানির বিজ্ঞাপন। নাকফুলের উপর বিশেষ ছাড়। হাজারো ডিজাইনের নাকফুল, পাশে দাম লেখা।
আমি কাগজগুলো ভাজ করে টেবিলে রেখে দেই। দুই কুদ্দুসের এক কুদ্দুস কী যেন বলে। আমার কানে শুধু ভাইরাল আর ট্রল শব্দ দু’টি আসে। আগে পরের শব্দগুলো কানে আসে না। কুদ্দুস আবারো বলে, ‘স্যার, তরুণ তরুণীরা নাকফুল পরে আপনার গল্প পড়ছে। আর পোস্ট দিচ্ছে ফেসবুকে। সুপার ভাইরাল। এদিকে ট্রল শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে এগুলো তিন পক্ষের কারসাজি। পত্রিকাওয়ালা, প্লাটিনাম ওয়ার্ল্ড আর আপনি মিলে এটা করেছেন। মাঝখানে নাকফুলগুলো বিক্রি হয়ে গেল।’
কুদ্দুস মনে হয় আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল যা আমার বিপক্ষে যায়। সমালোচনামূলক কিছু একটা। কিন্তু সেগুলো আমার একটুও শুনতে ইচ্ছে করছিল না। এ বয়সে এসে নেতিবাচক কথা শুনলে নিজেকে ঠিক রাখা যায় না। মনের ওপর খুব চাপ পড়ে। মনের চাপ প্রভাবিত করে শরীরকে। ফলে শরীরও বিগড়ে যায়। 
আমি শরীরটা এলিয়ে দেই ইজি চেয়ারে। কুদ্দুসকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না এখন। দুই কুদ্দুসের কোন কুদ্দুস বুঝতেও পারছি না। 
আবারও সেই তরুণী। নীল শাড়ি। চকচক করে ওঠা নাকফুল।  চোখে মুখে বৃষ্টির ঝাপটা। প্রথম বৃষ্টির পর মাটির ভেজা সুবাস এসে নাকে লাগে। 
এবার আমি তাকে চিনতে পারি। আমি একটা নাম বলি তাকে- তুমি কি সেই? 
তরুণী বলে, ‘না,  আমি তার মেয়ে। মাম্মি আমাকে এই নাকফুলটি আপনাকে ফেরত দিতে বলেছে।’
তরুণী হাত বাড়িয়ে নাকফুলের একটি বাক্স আমার দিকে এগিয়ে ধরে। আমি হাতে নিই। বলি, ‘এর ভেতরে তো নাকফুল নেই। ফাঁকা বাক্স।’ 
তরুণী বলে, ‘ওটা আমি পরেছি। মাম্মি জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনি নাকফুলটা পেয়েছেন। দেখেন তো কেমন লাগছে আমাকে?’
আমি তরুণীর দিকে তাকাই। মুখটা অস্পষ্ট হতে থাকে। কিছুই দেখতে পাই না। নীল তরুণী উধাও। নাকফুলের চকচকও উধাও।
দশ
দুই কুদ্দুস আমার সামনে চিন্তায় অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘স্যার, শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি বলি, ‘না,  শরীর খুব ভালো লাগছে। ভাবছি এবার অলিম্পিক দৌড়ে যাবো।’
নাকফুলের বাক্সটা তাদের দিকে বাড়িয়ে ধরি। বলি, ‘নাকফুলটা যতœ করে রেখে দাও। দুই কুদ্দুসের এক কুদ্দুস বলে, স্যার এটা তো একটা বাক্স, নাকফুল কই।’
আমি বলি, ‘কিছু ভুল, কিছু ফুল আর কিছু নাকফুল মাঝে মাঝে খালি চোখে দেখা যায় না।’

জ.ই

সর্বশেষ