বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ , ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

ভাষা আন্দোলন ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

শিল্প-সাহিত্য

অশোক অধিকারী

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ০৯:০৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

ভাষা আন্দোলন ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

চিত্র: রনি বর্মন

ভাষা আন্দোলনের রূপকার ও বিশিষ্ট রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করার জন্য নিষ্ঠুর ভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায় পাকিরা। “সর্বাঙ্গে জখম নিয়ে তাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটে যেতে দেখেছি।শক্তিশালী আঘাতের কারণে তাঁর একটি চোখ প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল।ফুলে গিয়েছিল সারাটা মুখ।মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল বাঁ পা।এভাবে এক পর্যায়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল মনীষী তুল্য এ ব্যক্তিকে।একটি নিচু জায়গায় কিংবা গর্তের পারে দাঁড় করিয়ে দত্ত বাবুকে গুলি করা হয়েছে।”রমণী শীল।দত্তবাবু জেলে থাকার সময় যিনি তাঁর চুল দাড়ি কাটতেন সেই ক্ষৌরকর্মী রমণী।নিজের চোখে সেই ভাষা সৈনিকের ওপর অত্যাচার পর্ব তিনি দেখেছেন। কিন্তু কে এই ধীরেন্দ্রনাথ।বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম সৈনিক।১৯৪৮র ২৫ আগস্ট তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তান গণ পরিষদে সোচ্চার হন।শুধু কথার কথা নয়,রীতিমতো তথ্য-তত্ত্ব ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার উপাত্ত ও জনবিন্যাসের ভিত্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের সম্যক চিত্র তুলে ধরেন অধিবেশনে।পাকিস্তানের ৬কোটি ৯০লক্ষ মানুষের ৪কোটি ৪০ লক্ষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা।শতাংশের বিচারে ৫৬%মানুষের ভাষা ছিল বাংলা।অন্যদিকে মাত্র৭.২% মানুষের ভাষা উর্দু।তবুও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মহম্মদ আলিজিন্নার আধিপত্যকামী হুংকার ছিল,“উর্দু,কেবল উর্দুইহবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”ধীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি হল তার বাংলাভাষা।সেই সংস্কৃতিকে আন্দোলনে রূপ দিতে তাঁর সাথী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭-র ডিসেম্বরে ১৪জন ভাষাবীরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ২১দফা দাবি সম্বলিত ইশতেহার তৈরি করেন,যার ২নং দাবিটিই ছিল মাতৃভাষার পক্ষে। পাকিস্তান গণ পরিষদ যখন ইংরেজি ও উর্দুর পক্ষে সওয়াল করে তখন ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গটি গণ পরিষদে বারবার তুলতে থাকেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন,“we are to consider that in our state it is found that the majority of the people of the state do speak the Bengali language then Bengali should have an honoured place even in the central government. ” যথারীতি নাকচ হয়ে যায় তাঁর প্রস্তাব।তবুও তিনি পরিষদের কার্যবিধির ২৮নং ধারার উপর একটি সংশোধনী এনে বলেন,”রাষ্ট্রপ্রধানের উর্দুর পক্ষে যে প্রস্তাব তা প্রাদেশিকতা মনোভাব প্রসূত।সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কথিত বা ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা হওয়া বাঞ্ছনীয়।”সম্যক বিরোধিতায় নামেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও গণ পরিষদের সহ সভাপতি মৌলভি তামিজউদ্দিন খান।ধীরেন্দ্রনাথের পক্ষে ছিলেন গণপরিষদের সদস্য দিনাজপুরের শ্রীযুক্ত প্রেমহরি,ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।মজার বিষয় হলো গণপরিষদের ৭৯সদস্যের পূর্ববঙ্গের ৪৪জন সদস্য উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মুসলিম ঐক্য ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তাঁরাও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় ধ্বনিভোটে ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। পরে পরেই শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলন। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি।হরতাল।শোক দিবস।শহিদ দিবসে উত্তাল হলো জেলা শহর কুমিল্লা।নেতৃত্বে তিনি।‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’উত্তাল স্লোগানে জনপদে সবার আগে তিনি।১৯৫৮য় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালিদের বিপুল জয় লক্ষ্য করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসক পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট অগণতান্ত্রিক উপায়ে ভেঙে দেয়। ১৯৬৬তে তিনি কারারুদ্ধ হন।ছাড়া পান।১৯৭১র ২৯মার্চ কুমিল্লার বাসভবন থেকে আবার তিনি ও তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার পুলিশ।সেখানেই অকথ্য নির্যাতন ও শেষে গুলি করে মারা হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে।প্রথম ভাষা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন লেখেন,“শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছেন।তিনি শুধু বীর ভাষা সংগ্রামীই নন,মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদও বটে। তাঁকে স্মরণ করা মানেই বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয় ও অমর চেতনাকে স্মরণ করা।” তবু,তাঁর নাতনি সমাজকর্মী আরমা দত্তর আক্ষেপটিও মনে রাখার মতো।কুমিল্লায় তাঁর নামে স্টেডিয়াম হয়েছে সত্য,কিন্তু আজও বাংলা অকাদেমির সামনে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ হয়নি। তাঁর কাজকর্ম বিশেষত ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে ইতিহাস তা আজও রচিত হয়নি।এমনকি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁর নামে ‘ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ আইনের বেড়াজালে আজও আটকে রয়েছে।বাংলাভাষা ও বাংলার স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায়ের প্রথম শহীদকে তবে কি আমরা ভুলতে বসেছি!শুধু বাংলাদেশে নয়,এপার বাংলাতেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম একুশের পলাশ দিনে উচ্চারিত হয় না।একটিও মালা বরাদ্দ থাকে না তাঁর নামে।তবু আসে একুশ।একুশের যে ইতিহাস তাতে যুক্ত বাংলার স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিরুদ্ধে দেশীয় শিক্ষার প্রসারের আন্দোলন,সেই সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও তার অনুসঙ্গে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির প্রনয়ন।একুশের প্রেরণায় যুক্ত বাংলার এই সংযুক্ত আবেগ জারি ছিল বলেই ভাষার আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পেরেছিল।ভাষার প্রতি আবেগ তাই বহুমাত্রিক।স্বাধীনতার পরে প্রথম একটি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন যা সর্ব শ্রেণির মানুষের সমর্থন পেয়েছিল।তার ভালোবাসার অন্দরে জায়মান ছিল ও এখনও আছে ঐতিহাসিক সন্ময়তা।যে কারনে একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় একটি ভাষার। আন্দামানের বো উপজাতির সব শেষ প্রতিনিধি ৮৫বছরের ‘বোয়া সিনিয়র’-র মৃত্যুর সঙ্গেই ভাষার ইতিহাসে ৬৫হাজার বছরের প্রাচীন এক ইতিহাসের অবলুপ্তি ঘটেছে।প্রসঙ্গত নেপালের ‘ডুরা ভাষা’-ও তার সর্বশেষ প্রতিনিধি সোমাদেবীর মাধ্যমে বেঁচে আছে।তাঁর মৃত্যুর পর ডুরাভাষাও হারিয়ে যাবে।
     ১৯৯৬। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বার্সেলোনা সম্মেলনে ঘোষিত হলে‘ভাষার অধিকার একটি বিশ্বজনীন অধিকার।’পরে পরেই বিশ্বের ১০জন বিশিষ্ট ভাষাবিদের পাঠানো এই সর্বজনীনতা কে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শাখা সংগঠন ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭নভেম্বর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে,‘ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধে মানুষকে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি এই পবিত্র দিনটি বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সম মর্যাদায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হবে।সে অর্থে মাতৃভাষা দিবস এ বছর একাত্তরে (১৯৫২) পা দিল।তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বছর(১৯৯৯) ধরলে এবছর তার ২৪শে পা।কেমন আছে বাংলাভাষা! ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ-মরি বাংলাভাষা’-র শরীরে হিন্দি ও ইংরেজির যে শাল-আলোয়ান চেপেছে তাতে স্বভাবতই মনে পড়বে ইউনেস্কোর“অঃষধং ড়ভ ডড়ৎষফ’ং খধহমঁধমবং রহ উধহমবৎ ড়ভ উরংধঢ়ঢ়বধৎরহম”-রিপোর্ট যেখানে বলা হচ্ছে বিপন্ন ভাষার তালিকায় ভারত রয়েছে সবার ওপরে।বর্তমান বিশ্বে ৭০১৬টি ভাষা রয়েছে।এর মধ্যে দু’হাজারের মতো ভাষা আছে যাতে এক হাজারেরও কম মানুষ কথা বলে।চালু ভাষাগুলির অর্ধেক আগামী একশো বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে! যার অবশ্যম্ভাবী ফল ফলছে আমরা দেখছি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন,প্রতি ১৪দিনে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে।ফরাসী গল্পকার আলফাস দোদে’র কথা এ প্রসঙ্গে পাড়া যায়ঃ“জাগতিক সমস্ত সম্পদ হারিয়েও মানুষ পৃথিবীতে থাকবে যদি তার ভাষা সুরক্ষিত থাকে।আর যদি সেই ভাষা অবমানিত হয় তাহলে সে সবই হারাবে।”পৃথিবীর মধুরতম ভাষার স্বীকৃতি যার ঝুলিতে।রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩-য় যে ভাষাকে বিশ্বের দরবারে গরবের আসনে আসীন করে গিয়েছিলেন,তার কৌলীন্যে আজ কৃত্রিমতার ইংরেজিয়ানা বিপন্নতার পাসওয়ার্ড নিয়ে হাজির হয়েছে।আমরা এজন্যে বিশ্বায়নকে গালমন্দ করে থাকি। কিন্তু একটিবারও ভাবি না,ইংরেজি আমাদের শিখতেই হবে,সত্য।ওটা কাজের ভাষা। কিন্তু ঘরের ভাষার অন্তর্জলি দিয়ে নয়!অমর্ত্য সেন প্রায়শই বলে থাকেন,আমি তো স্কুলে বাংলায় পড়েছি,কোনো ক্ষতি হয়নি তো।আরেকটু এগিয়ে তিনি বলেন,ইংরেজিতে দক্ষতা থাকা দরকার অবহেলা করা উচিত নয়।চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা হয়।ইংরেজি শিক্ষায় চিন্তার প্রসার ঘটে। কূপমণ্ডূক হওয়ার সম্ভবনা কমে। তাহলে এই যখন নিদান আমরা কেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করার ফর্ম তোলার লাইনে রাতভর দাঁড়িয়ে আওড়াই, সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না!’

অশোক অধিকারী রামরাজাতলা,হাওড়া , পশ্চিমবঙ্গ

জ.ই

সর্বশেষ