সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ , ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

modhura
Aporup Bangla

ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং আমদের দায়

শিল্প-সাহিত্য

খৈয়াম কাদের 

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১২:৫২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বশেষ

ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং আমদের দায়

চিত্র: রনি বর্মন

বাঙালির জাতিত্ব-পরিচয়ের প্রথম ও প্রধান বস্তু তার ভাষা, হাজার প্রজন্মের আবহ-ঐতিহ্যের বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের বাঙালিরা তাঁদের জাতিগত আত্মপরিচয়ের স্মারক এই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছেন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে; এবং জীবন উৎসর্গকারী এই আন্দোলনের পথ ধরেই তাঁরা দীপ্র ও ক্ষীপ্র গতিতে পৌঁছে গেছেন বহু জনমের স্বপ্বলালিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির সর্বোচ্চ চূড়ায়। একারণে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা-আন্দোলনকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির ভ্রুণ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রায় দু'শো বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নিপিড়ন থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ভারতবর্ষের দুই বিপরীত প্রান্তের অতিদূরবর্তী দু'টি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান নামে যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার কেন্দ্রীয় শাসনের দণ্ড থাকে দেশটির পশ্চিমাংশের হাতে।সদ্যজাত এই রাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট পশ্চিমা শাসকবর্গ শুরু থেকেই দেশের পূর্ব অংশ তথা পূর্ববঙ্গ বা পূর্বপাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে চরম বৈরী আচরণ করতে থাকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তারা পূর্বপাকিস্তানের মানুষের কাছে আরেক ঔপনিবেশিক প্রভূ রূপে আবির্ভূত হয়। তাদের নানামুখী বিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গটি বাঙালি মানসকে সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত করে। বৃটিশ শাসনের নাগপাশমুক্ত নবসৃষ্ট পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালি হওয়া সত্তেও স্বল্পসংখ্যক মানুষের ভাষা উর্দুকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, এবং আঞ্চলিকতার হীনমন্যতাপুষ্ট এই কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারীর বিয়োগান্তক ঐতিহাসিক ঘটনা ;মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে পাকিস্তানের বর্বর শাসকদের নগ্ন আক্রমণে রাজপথে শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম বরকত ও জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ঘটনা পরম্পরার এই পর্যায়ে এসে বাঙালিরা স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাঁদের নয়,তাঁদের জন্য নয়।সুতরাং সামগ্রিকভাবে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আর কোনো বিকল্প তাঁদের হাতে নেই। তখনই ব্যাপক প্রতিরোধের মাধ্যমে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। নেতৃত্ব দেন সময়ের নির্ভিক সারেং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক সাগর তাজা রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় হাজার বছরের কাঙ্খিত বিজয়,প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বোভৌম বাংলাদেশ, জাতীয়তার স্বতন্ত্র পরিচয়ে উদ্ভাসিত হয় বীরবাঙালি জাতি।


জাতির নাম বাঙালি, জাতীয় ভাষার নাম বাংলা, রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ-- একই সত্তার এমন ত্রৈয়ী বিকাশ বিশ্বের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে বিরল। এখানেই নিহিত বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্য,অনন্য পরিচয় এবং অতুল্য শক্তি। বাংলাভাষা এবং এর অক্ষর,ধ্বনি ও বর্ণমালার রয়েছে অপার ঐশ্বর্য। বৈচিত্র্যময় স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনি এবং তাদের নিমিত্তক নানাপ্রকার 'কার,ফলা,রেফ,হস এবং যুক্তরূপ এ ভাষাকে সমৃদ্ধ এবং সম্পন্ন ক'রে তুলেছে। বহুপথীয় বিমিশ্রতার সমাহারে ব্যাপক সম্প্রসারিত এ ভাষার শব্দভাণ্ডার। এর উচ্চারণ বৈচিত্রও বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। পৃথিবীর যেকোনো ভাষার যেকোনো উচ্চারণ ও শব্দধ্বনিকে ধারণ ও প্রকাশ করার পরিপূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে এ ভাষার। বিশ্বভাষা ইংরেজি যেমন গীক,ল্যাটিন ও ফ্রেন্সসহ বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ-অভিধা আত্মীয়করণের মাধ্যমে আজকের সমৃদ্ধরূপে উপনীত হয়েছে বাংলা ভাষাও তেমন সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু,আরবি, ফার্সি,তুর্কি,পর্তুগিজ,মঙ্গলীয়, চৈনিক এবং ইংরেজি থেকে বেশুমার শব্দ সংগ্রহের মাধ্যমে অর্জন করেছে বর্তমানের প্রাচুর্য ও নান্দনিক জৌলুশ। ভাষাই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম সাংস্কৃতিক সম্পদ,জাতীয় স্বাতন্ত্র্য সনাক্তির সূর্যশক্তি।বিলম্বে হলেও পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকবর্গ এ শক্তিকে উপলব্ধি করতে পারে, এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।তবে তারা তাদের কুৎসিত চক্রান্ত থেকে নিবৃত্ত হয় না।বরং নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বোনে।পূর্ববাংলার জনমণ্ডলীকে তারা ধর্মের আবরণে বুঝাতে চায় যে বাংলা বর্ণমালা হিন্দুর সম্পদ।সুতরাং পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা তাদের বাংলভাষা চর্চা করবে আরবি অথবা উর্দু হরফে যাতে ক'রে তাদের মুসলমানিত্ব এবং তৎসংক্রান্ত ঈমান অক্ষুণ্ণ ও অক্ষত থাকে।এমনকি বিশ্বনন্দিত সাহিত্যগুরু রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত তারা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস চালায়।কিন্তু সেই সময়ের আমাদের অকুতোভয় পূর্বজগণ এই ন্যাক্কারজনক অপচেষ্টাকে চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। অথচ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁদেরই উত্তর প্রজন্মের মানুষ আমরা কোনরকম চাপ ও প্রলোভন ছাড়াই নিতান্ত নির্লজ্জের মতো ইংরেজি হরফে বাংলা লিখছি বিশ্ববিহারি অনলাইন মাধ্যমে। এত ক'রে বাংলাভাষার স্বর এবং ব্যঞ্জন ধ্বনির মাধুর্যময় উচ্চারণগুলি ভীষণভাবে বিকৃত হচ্ছে। মাতৃভাষার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী পূর্বপ্রজন্মের প্রতি একি আমাদের চরম উদাসীনতা এবং অকৃতজ্ঞতা নয়?স্মর্তব্য, ইংরেজি একটি শক্তিমান ও সমৃদ্ধ ভাষা হলেও এর বর্ণমালা কিন্ত সর্বত্রমুখী ধ্বনি ও উচ্চারণ ধারণে বাংলা বর্ণ ও ধ্বনিমালার মতো সর্বভূক শক্তির অধিকারী নয়।এমন একটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভাষা-সম্পদের স্বত্বাধিকারী হয়েও আমরা আত্মগ্লানিময় পরপ্রীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি।শুধু তাই নয়,নিদারুণ নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখেও আমাদের পিতা-পিতামহ এবং  মাতা-মাতমহরা উর্দুভাষাকে কবুল ক'রে নেননি। অথচ আমরা আজ একেবারে স্বেচ্ছায় হিন্দি ও ইংরেজির কাছে মাথা নুয়ে ব'সে আছি। স্মরণীয়, একথার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশিক যোগাযোগের ভাষা ইংরেজির শিখন ও ব্যবহারের বিষয়টি কোনভাবেই অস্বীকার করা হচ্ছে না।বরং যে সকল ভিনভাষী শব্দ শাব্দী ও আর্থি সমন্বয়ে আমাদের ভাষার অভিধানে স্বাভাবিকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে সেসব নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই বলেই আমরা মনে করি।কিন্তু যে সকল ক্ষেত্রে আমাদের নিজ ভাষার শব্দ, শব্দাভিধা এবং শব্দরাজি যুৎসইরূপে প্রয়োগযোগ্য সেখানে কোনো বিভাষী শব্দকে জোরপূর্বক প্রতিস্থাপন করা একটি ঘৃণ্য এবং হীন অপরাধ। এতে ক'রে আমাদের স্বদেশ ও স্বভাষার প্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সবশেষে বলতে হয় বাঙালিকে সচেতন হতে হবে,ফিরতে হবে স্বজাত্যবোধে। শাণিত ও সমৃদ্ধ করতে হবে স্বভাষার শক্তি, শৌকর্য ও অহংকে। স্মরণে রাখতে হবে পূর্বপুরুষের ত্যাগ ও নিজেদের দায়কে।

জ.ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়