ছবি-সংগৃহীত
রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর জি এম তাদের তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর থেকে জাতীয় পার্টিতে দুই নেতার বিরোধ অনেকটা মিটে গেছে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু দলের নেতারা বলছেন, দ্বন্দ্বের কোনো সুরাহা হয়নি। জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের বৈঠকের পর দলের অনেকই ধরে নিয়েছিল দলের টানা দুই মাসের দ্বন্দ্ব-বিভেদের অবসান হয়েছে। কিন্তু এক দিন পরেই দুই পক্ষের নেতারা জানান, এই দ্বন্দ্ব দূর হয়নি।
দুই পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতৃত্বের টানাপড়েন এখনও চলছে। অনেক বিষয়েই সমঝোতা হয়নি। রওশন এরশাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, মীমাংসার উদ্যোগ জি এম কাদেরকেই নিতে হবে। জাতীয় পার্টিতে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখান থেকে রওশনের পাঠানো এক চিঠিকে কেন্দ্র করে। ৩১ অক্টোবরের ওই চিঠিতে হঠাৎ করে তিনি ২৬ নভেম্বর দলের সম্মেলনের ডাক দেন। পরে অবশ্য তা স্থগিত করা হয়। এর পর রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল স্পিকার ড. শিরিন শারমিনের কাছে চিঠি দেন। দলটির ২৬ এমপির মধ্যে রওশন এরশাদ এবং তার ছেলে সাদ এরশাদ ছাড়া বাকি ২৪ জন এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়ে এতে সই করেন। এ পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হয়, রওশন দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে সংসদের বাইরে আছেন।
রওশন এরশাদের অপসারণের উদ্যোগটি সঠিক ছিল না– একটি গণমাধ্যমে এমন মন্তব্য করায় জাতীয় পার্টির সকল পদ থেকে অব্যাহতি পান দলের সাবেক মহাসচিব ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। এভাবে দল কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সে সময় দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা গত ৪ অক্টোবর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন।
তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জি এম কাদেরের দলীয় যাবতীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী আদেশ দেয়। তবে হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়ালের একক বেঞ্চ মঙ্গলবার বিচারিক আদালতের এ আদেশ স্থগিত করে। এর ফলে দলে চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছিলেন কাদের। তবে গত বুধবার হাইকোর্টের সেই আদেশ বুধবার চেম্বার জজের আদালত স্থগিত করে দিয়েছে।
বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চেও পাঠিয়েছে চেম্বার আদালত। সোমবার এ শুনানির আগ পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত থাকবে। ফলে আপাতত আবার দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন জি এম কাদের। জাতীয় পার্টির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের বৈঠকের পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে কোন্দল, তা মিটে গেছে। কিন্তু বুধবার আদালতের রায়ে তারা চুপ হয়ে গেছেন। দলে এ বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে নতুন করে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আবার দ্বন্দ শুরু হতে পারে।
বিভক্তি বাড়তে পারে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে। দলে জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দলীয় নেতারা এখন আদালতের দিকে তাকিয়ে আছেন। আদালতের আদেশের কারণে গত এক মাস রাজনৈতিক সকল বিষয় থেকে বিরত আছেন জি এম কাদের। তবে গত মঙ্গলবার তার সঙ্গে রওশন এরশাদের যে বৈঠক হয়েছে, তাতে ‘ভুল বোঝাবোঝির অবসান’ হয়েছে। তবে তারা মনে করেন, রওশন এরশাদের পাশে এমন কেউ আছেন, যিনি উনাকে ফের ভুল বুঝিয়েছেন।
এর ফলেই মীমাংসার পরও দ্বন্দ্ব চলমান আছে। জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যে বিভেদ, তা রয়েই গেছে। দলের দুই পক্ষেই এমন কয়েকজন রয়েছেন, যারা আসলে দলের মধ্যে ঐক্য চান না। তারাই নিজেদের স্বার্থে ওই বিবাদ বিরাজমান রেখেছেন। রওশনপন্থিদের মধ্যে কয়েকজন মনে করছেন, দলের বিরোধ জিইয়ে রাখলে লাভবান হবেন তারা নিজেরা। এর মাধ্যমে তারা সরকারের আনুকুল্য যেমন পাবেন, তেমনি আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের দৌড়েও এগিয়ে যাবেন।
অপর দিকে জি এম কাদেরের পাশে এমন কয়েকজন নেতা রয়েছেন, যারা রওশন এরশাদকে দলের নেতৃত্বে টিকতে দিতে চান না। কারণ এতে রওশনের কথায় মনোনয়ন দিতে হবে। তবে আদালতের স্থগিতাদের ওপর শুনানির পর মীমাংসার আশা করছেন দলের কেউ কেউ। জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য ও জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রওশন এরশাদের পাশে থেকেই কেউ দুষ্টামি করছেন।
দলের নেতাদের আশা দলে ঐক্য হোক। রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের বৈঠকে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছিল। কিন্তু রওশন এরশাদ তো অসুস্থ্, উনার পাশেই কেউ বিরোধ জিইয়ে রাখতে চাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদ দেশে ফিরে যে ঐক্যের কথা বললেন, সে অনুসারে তো দলের নেতাকর্মীরা আশাবাদী হয়েছে। এ কারণে দলের চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আসলে উনারদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
বিভেদ রওশন এরশাদের পাশের কেউ করছেন। কিন্তু এই দল এক হতেই হবে। আমরা কোনো দুষ্টু লোককে জায়গা দেব না।’ জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, এক মাস ধরে মামলা চলেছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে। তখন দলের নেতারা চুপ ছিলেন। এখনও চুপ থাকবেন। কারণ তারা আদালতের ওপর শ্রদ্ধাশীল। তবে জাতীয় পার্টির নেতারা উচ্চ আদালতে এ বিষয়টির মোকাবেলার কথাও বলছেন। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন আদালতেই আমাদের বিষয়টা ফেস করতে হবে।
এ ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা নেই।’ তবে দলে মীমাংসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে তো ঝগড়াই হয়নি, তাহলে মীমাংসা কেন?’ স্পিকারের কাছে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের দেওয়া চিঠির বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত এখনও আগের মতো কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা যে চিঠি দিয়েছি, তার সিদ্ধান্ত তো ঝুলে আছে। আপনারা ওই চিঠির বিষয়ে স্পিকারের সঙ্গে কথা বলেন।’ স্পিকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ওইটা তো স্পিকারের কাছে আছে।
উনিই সিদ্ধান্ত দেবেন।’ জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আশা করি, আদালতের স্থগিতাদেশের বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিলিফ পাব। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’ এ বিষয়ে জাতীয় পার্টি সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সোমবার দিন আদালতের শুনানিতে যাচ্ছি।’ মীমাংসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের শীর্ষ দুই নেতা বৈঠক করেছেন। দুই জনই মীমাংসার বিষয়ে পজিটিভ বলেছেন।
পরবর্তীতে উনারা দুই জন বসে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা কিছু দিন পরে হওয়ার কথা।’ জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কাজী মামুনুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মীমাংসার উদ্যোগটা জি এম কাদেরকেই নিতে হবে। রওশন এরশাদ তো ওনাকে ডাকছেন, উনিও (জি এম কাদের) আসছেন, কথা বলেছেন। এখন পরবর্তীতে মীমাংসার বিষয়টি জি এম কাদেরকেই করতে হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে ওয়েট করছি। দেখি কী হয়। আমাদের যে কাউন্সিলের ডাক দিয়েছি, তা নিশ্চয়ই চলমান থাকবে, তবে ম্যাডাম (রওশন এরশাদ) বলেছেন, তোমরা একটু অপেক্ষা করো।’ তবে জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতি এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার দলের শীর্ষ দুই নেতার বৈঠকে সাংগঠনিক কোনো আলোচনাই হয়নি। এ কারণে দলের যে কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে আমরা কাজ করে এগিয়ে যাব।
এর মধ্যে যদি মিসাংসা হয়, তাহলে ভালো, না হলে কাউন্সিল হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই ম্যাডামের নেতৃত্বে দল চলুক। তবে সে ক্ষেত্রে যাতে দলের বহিষ্কৃত নেতাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তবে জি এম কাদের দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকুক, এটা আমরাও চাই।
এনসি/